NRD NEWS,
আদিমকালের কথা মনে হলেও এটাই সত্য এর টুকরো প্রতিচ্ছবি যেন খুজে পাওয়া যায় , সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলার নিজপাট ইউনিয়নের অধিকাংশ গ্রামে। টিউবওয়েল নেই, উঁচুনিচু পাহাড় আর টিলাবেষ্টিত সেই গ্রামগুলোর পানির প্রধান উৎস হচ্ছে কুয়া। ওই গহীন কুয়ার পানির উপর নির্ভরশীল কয়েক হাজার মানুষের জীবন। এমনকি গ্রামের মসজিদগুলোতেও ওজুর কাজ চালানো হয় ওই কুয়ার পানি দিয়ে। আর এভাবেই চলে আসছে অন্তত চারশত বছর ধরে।
সিলেট শহর থেকে প্রায় ৪২ কিলোমিটারের দূরত্ব জৈন্তাপুর উপজেলার নিজপাট ইউনিয়ন। সেখানে রয়েছে নয়টি ওয়ার্ড। গ্রাম রয়েছে ৬৫টি। এই গ্রামগুলোতে নেই কোন টিউবওয়েল । অনেকে টিউবওয়েল স্থাপন করেও সফল হননি পানি সংগ্রহনে। উঁচু-নিচু টিলা আর পাহাড়ি জনপদ হবার ফলে গ্রামের মাটির তলদেশে প্রচুর পাথরের অস্তিত্ব রয়েছে। ফলে টিউবওয়েল বসিয়ে কখনো সুফল পাননি গ্রামের বাসিন্দারা।
আর তাই যুগ যুগ ধরে সেই মানুষগুলোর পানির একমাত্র উৎস হলো কুয়া। স্থানীয়ভাবে যাকে ইন্দারা বলা হয়।
নিজপাট ইউনিয়নে আছে উজানীনগর, মোকামটিলা, যশপুর, গৌরিশংকর, কমলাবাড়ী, ফুলবাড়ি, গিলারতল ও ডিবির হাওর গ্রাম।
তার মধ্যে শুধু উজানীনগর গ্রামেই বসবাস করে ১৭৪ পরিবার। সেই গ্রামের প্রতিটি ঘরে অন্তত একটি করে কুয়া আছে। কোনো কোনো বাড়িতে আছে একাধিক। বাসাবাড়ির দৈনন্দিন কাজ থেকে শুরু করে মসজিদের ওজুর কাজেও কুয়ারপানি ব্যবহার হয়। প্রায় চারশ বছর ধরে তারা এসকল কুয়া থেকে পানি উত্তোলন করে পানির চাহিদা মিটাচ্ছেন তারা। তবে, বর্তমানে পানি উত্তোলনে লেগেছে প্রযুক্তির ছোঁয়া। যাদের সামর্থ্য আছে তারা মোটর দিয়ে পাইপলাইনের মাধ্যমে কুয়ার পানি ছাদের উপর ট্যাংকিবন্দী করতে পারছেন।
সরেজমিন কথা হয় উজানীনগরের বাসিন্দা সাবেক বিজিবি কোম্পানী কমান্ডার আলহাজ্ব ফজলুল হকের সাথে। তার সাথে কথা বলে জানা যায় ‘নিউপাট ইউনিয়ন ছাড়াও জাফলং এলাকাতেও এ ধরণের কুয়া যুগের পর যুগ ধরে ব্যবহার হচ্ছে। এর কারণ হলো সেসকল পাহাড়ী এলাকার মাটির তলদেশে পাথরের উপস্থিতি বেশী। ফলে টিউবওয়েলের পাইপ স্থাপন করে সুফল পাওয়া যায়না। এজন্য কুয়া ছাড়া আমাদের বিকল্প কিছু নেই।’
তিনি আরো বলেন, ‘আমার বাড়িতে দুটি কুয়া রয়েছে। এক একটিতে দেড় থেকে দুই লক্ষাধিক টাকা খরচ হয়েছে। সেই পানি খুবই পরিষ্কার এবং সুস্বাদু। খাবার থেকে শুরু করে বাসাবাড়ির সবকাজে কুয়াই একমাত্র অবলম্বন ’
উজানীনগরে গ্রামীন ব্যাংকের পাশের বাসার বাসিন্দা হানিয়া বেগম। আনুমানিক সত্তর বছরের এই বৃদ্ধা। পাকিস্তান আমল থেকে কুয়ার পানি ব্যবহার করছেন তিনি গ্রামীন ব্যাংকের পাশে থাকা বৃটিশ আমলের পুরনো কুয়াটি দেখিয়ে স্মৃতিচারন করে বলেন , ‘সেই ছোটবেলা থেকে এই কুয়ার পানি এখনো আমাদের ভরসা।’
কথা হয় পাশের গ্রাম মোকামটিলার আল আমিনের সাথে। তিনি জানান, ‘চৈত্র ফাল্গুন মাসে কুয়াগুলোতেও পানির অভাব থাকে, তখন গোসলের জন্য, পানির জন্য কিছুটা কষ্ট পোহাতে হয় সবাইকে। বিশেষ করে বৃষ্টি না হলে পানি কমে আসে।’
পেশায় শিক্ষক মো. কুতুব উদ্দিন গৌরি শংকর। তিনিও গ্রামের ঘরে ঘরে কুয়ার গুরুত্ব শুনান,তিনি জানান যে ‘শুধু বাসাবাড়ি, অফিস নয়, প্রতিটি মসজিদ কিংবা মন্দিরেও কুয়ার পানিই ভরসা। অধিকাংশ মসজিদের উপর বসানো ট্যাংকিগুলোতে পানি তোলা হয়বৈদ্যুতিক মোটরের মাধ্যমে। তবে একসময় বালতি দিয়ে পানি তুলতে হতো। এখন অনেকে বালতি দিয়ে না তুলে বৈদ্যুতিক মটর ব্যবহার করছেন।’
এ প্রসঙ্গে কথা তরুণ গবেষক লেখক আব্দুল হাই আল হাদীর সাথে কথা হলে তিনি বলেন, আনুমানিক চারশ বছর আগে জৈন্তিয়া রাজার প্রধান সেনাপতি শহীদ ফতেহ খা’র আমল থেকে কুয়া বা ইন্দারা পরিচিতি লাভ করেছে। যা আজও বিদ্যমান তাদের জনজীবনে।