একটা সূঁচ, একটুখানি সূতা’র ছোঁয়ায় কেবল কাপড় নয়, বদলে যাচ্ছে জীবন।
নেত্রকোনার ইসলামপুর এলাকার এক সাধারণ ঘরের স্বপ্ন প্রতিষ্ঠান “স্বপ্নবুনন সেলাই শিখন কেন্দ্র” আজ হয়ে উঠেছে শত শত নারীর স্বপ্ন দেখা স্বপ্ন ছোঁয়ার নির্ভরযোগ্য আশ্রয়। এই রূপান্তরের পেছনে আছেন এক অদম্য নারী, নিরব সংগ্রামী তাহমিদা ইসলাম, যিনি বর্তমানে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের অস্থায়ী প্রশিক্ষক হিসেবেও কাজ করছেন।
২০০৫ সাল। সমাজের চোখে গুরুত্বহীন এক কাজ নিয়ে যাত্রা শুরু করেন তাহমিদা ইসলাম। মাত্র তিনজন নারী নিয়ে শুরু হওয়া সেই ছোট উদ্যোগটির পেছনে ছিল এক গভীর বিশ্বাস-নারী শুধু কারো উপর নির্ভর করে বাঁচার জন্য নয়, তারা নিজেরাই হতে পারে নিজের জীবনের নির্মাতা।
কেউ পাশে দাঁড়াননি শুরুতে। তবুও থেমে যাননি।
নিজ হাতে গড়েছেন একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, যেটি কেবল কাপড় সেলাই শেখায় না-গড়ে তোলে আত্মবিশ্বাস, আত্মনির্ভরতা আর সম্মান।
আজ সেই ছোট ‘স্বপ্নবুনন’-এ প্রশিক্ষণ নিয়েছেন ৭০০-৮০০ জনেরও বেশি নারী।
কেউ খোলেন টেইলারিং শপ, কেউ ঘরে বসেই নিচ্ছেন পোশাক তৈরির অর্ডার, আবার কেউবা ফেসবুক পেজের মাধ্যমে পৌঁছে যাচ্ছেন দেশের বাইরেও।
এই নারীদের অনেকেই এখন পরিবারের মূল উপার্জনকারী। তাঁদের জীবনে ‘স্বপ্নবুনন’ শুধু একটি প্রশিক্ষণকেন্দ্র নয়, নতুন জীবনের দরোজা।
তাহমিদা ইসলাম শুধু শহরে সীমাবদ্ধ থাকেননি। পা রেখেছেন নেত্রকোনার প্রত্যন্ত গ্রামেও।
চলেছেন বিধবা, স্বামী-পরিত্যক্তা বা দরিদ্র গৃহবধূদের কাছে।
নিজে হাতে ধরে শিখিয়েছেন ব্লাউজ, পেটিকোট, থ্রিপিস কিংবা শিশুদের পোশাক তৈরির কৌশল।
শুধু সেলাই শেখানোই নয়-শিখিয়েছেন কিভাবে বাজার ধরতে হয়, কীভাবে নিজের তৈরি পোশাক বিক্রি করে উপার্জনের পথ তৈরি করা যায়।
“আগে মানুষ বলত, সেলাই শিখে কী হবে? এখন তারাই এসে প্রশংসা করে,”- বলছিলেন তাহমিদা ইসলাম এক গাল হাসি নিয়ে।
বর্তমানে তিনি যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের অস্থায়ী প্রশিক্ষক, যা তাঁর দীর্ঘদিনের শ্রম ও নিষ্ঠার একটি আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি। সরকারি পর্যায় থেকে পাওয়া এই মর্যাদা যেন আরও উৎসাহ যোগায় তাঁকে ও তাঁর শিক্ষার্থীদের।
প্রতিদিন ‘স্বপ্নবুনন’-এ আসেন ৫০-৬০ জন নারী কারও হাতে স্কুলব্যাগ, কারও চোখে সংসারের ক্লান্তি, আবার কারও মনে নতুন জীবনের আশা।
তারা কেবল সেলাই শেখেন না, শিখেন নিজের পায়ে দাঁড়ানোর সাহস।
এই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটি হয়ে উঠেছে নেত্রকোনার নারীদের জন্য এক আলোকবর্তিকা, যেখানে প্রতিদিন জন্ম নিচ্ছে আত্মবিশ্বাসী নারীর নতুন গল্প।
তাহমিদা ইসলামের স্বপ্ন এখানেই থেমে নেই। তিনি চান এই মডেল ছড়িয়ে পড়ুক অন্য উপজেলাতেও।
স্বপ্নবুননের মতো আরও শত শত কেন্দ্র ছড়িয়ে পড়ুক সারা দেশে। প্রয়োজন শুধু একটু সহযোগিতা, নীতিনির্ধারকদের নজর এবং মানুষের আন্তরিক স্বীকৃতি।
তাহমিদা ইসলাম প্রমাণ করেছেন-স্বপ্ন শুধু চোখে দেখার বিষয় নয়, কিছু মানুষ থাকেন যারা অন্যদের হাত ধরিয়ে দেন সেই স্বপ্ন।
তাঁর হাতে সূঁচ-সূতা, মনে সাহস আর হৃদয়ে নারীদের জন্য অসীম ভালোবাসা- এই নিয়ে তিনি হয়ে উঠেছেন সত্যিকারের এক স্বপ্ন বোনার কারিগর।
লেখকঃ তাসমিয়া তহুরা