মিরপুর শেরে বাংলা স্টেডিয়ামের মাটি বরাবরই স্পিনারদের স্বর্গ। কিন্তু মঙ্গলবারের ওয়ানডে ম্যাচে সেই ‘স্বর্গ’ যেন পরিণত হলো স্পিনের পূর্ণ রাজ্যে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের অধিনায়ক শেই হোপ এমন এক সিদ্ধান্ত নিলেন, যা ৫৪ বছরের ওয়ানডে ইতিহাসে আগে কখনো দেখা যায়নি—পুরো ৫০ ওভারই বল করলেন স্পিনাররা!
বিশ্ব ক্রিকেটে এই কীর্তি একেবারেই নজিরবিহীন। এর আগে কোনো দল এক ইনিংসে টানা ৫০ ওভার স্পিনে বোলিং করানোর সাহস দেখায়নি।
মিরপুরের উইকেট ও পরিকল্পনা: শুরু থেকেই স্পিনের ভাবনা
ওয়েস্ট ইন্ডিজের টিম ম্যানেজমেন্টের কাছে জানা ছিল—মিরপুর মানেই টার্ন, গ্রিপ ও স্কিড। দলটির অনেকে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ (বিপিএল) খেলেছেন, কোচ ড্যারেন স্যামিরও জানেন এখানকার পিচের চরিত্র। তাই সিরিজের দ্বিতীয় ওয়ানডের আগে থেকেই তারা তৈরি রেখেছিলেন স্পিননির্ভর কৌশল।
প্রথম ম্যাচে তিন স্পিনার নিয়ে নামলেও অভিজ্ঞতায় বুঝে ফেলেন, এখানকার উইকেট শুধু “স্পিন সহায়ক” নয়, বরং একেবারে “স্পিনের খনি”। তাই জরুরি ভিত্তিতে ডেকে পাঠানো হয় বামহাতি স্পিনার আকিল হোসেনকে।
দীর্ঘ ফ্লাইট শেষে বাংলাদেশ সময় রাত আড়াইটায় ঢাকায় পৌঁছেই ম্যাচের দিনই একাদশে জায়গা পান তিনি। শুধু খেলেনই না, বল হাতেও ইনিংস শুরু করেন এই ক্যারিবীয় বোলার।
স্পিন আক্রমণে চার তারকা, সহায় আথানজে
ওয়েস্ট ইন্ডিজের একাদশে দেখা গেল চারজন নিয়মিত স্পিনার—গুডাকেশ মোতী, কেভিন সিনক্লেয়ার, রমারিও শেপার্ড (স্পিন ভ্যারিয়েশনসহ) এবং নতুন যোগ দেওয়া আকিল হোসেন। পেস আক্রমণ হিসেবে কাগজে ছিল শেরফান রাদারফোর্ড ও জাস্টিন গ্রেভস, তবে তাদের বোলিং দেখা যায়নি পুরো ম্যাচে।
স্পিনারদের পারফরম্যান্সে অনুপ্রাণিত হয়ে অধিনায়ক শেই হোপ শেষদিকে আক্রমণে আনলেন টপ-অর্ডার ব্যাটার ও পার্ট টাইম অফস্পিনার আলিক আথানজেকে। তাঁর নিয়ন্ত্রিত বোলিং ছিল ম্যাচের অন্যতম চমক—১০ ওভারে ১৪ রান দিয়ে ২ উইকেট তুলে নেন এই তরুণ। আরও অবাক করা তথ্য হলো, তাঁর ৬০ বলের মধ্যে ৫০ বলই ছিল ডট!
৫০ ওভার স্পিন—ক্রিকেট ইতিহাসে নতুন মাইলফলক
ওয়েস্ট ইন্ডিজের এই সিদ্ধান্ত ওয়ানডে ক্রিকেটে এক নতুন রেকর্ড গড়ে দিল। ১৯৭১ সালে ওয়ানডে যুগের সূচনার পর এটাই প্রথম ইনিংস, যেখানে কোনো দল একটিও পেসার ব্যবহার না করে পুরো ৫০ ওভার স্পিন বোলিং করিয়েছে।
এর আগে সবচেয়ে কাছাকাছি রেকর্ড ছিল শ্রীলঙ্কার দখলে।
- ১৯৯৬ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে তারা করিয়েছিল ৪৪ ওভার স্পিন।
- ১৯৯৮ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ৪৩ ওভার।
- ২০০৪ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষেও স্পিনে কাটে ৪৪ ওভার।
সাম্প্রতিক সময়ে ২০২৪ সালে নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে ওমান করিয়েছিল ৪৩.৪ ওভার স্পিন। কিন্তু ওয়েস্ট ইন্ডিজের মতো পুরো ৫০ ওভারই স্পিনে শেষ করার ঘটনা আগে কখনো ঘটেনি।
উল্লেখযোগ্য যে, ওয়েস্ট ইন্ডিজ পূর্বে কখনো ৩৫ ওভারের বেশি স্পিন বোলিং করায়নি। এবার সেই সীমা তারা ভেঙে দিয়েছে রীতিমতো দ্বিগুণ করে।
মিরপুরের উইকেট—স্পিনারদের স্বপ্ন, ব্যাটারদের দুঃস্বপ্ন
বিশ্লেষকদের মতে, মিরপুরের এই উইকেট স্পিনারদের জন্য ছিল আদর্শ, এমনকি “স্পিন স্বর্ণখনি” বললেও কম বলা হয় না। বল ব্যাটে আসতে দেরি, মাঝে মাঝে নিচু বাউন্স আর মাঝে মাঝে অতিরিক্ত টার্ন—সব মিলিয়ে ব্যাটারদের জন্য ছিল কঠিন পরীক্ষা।
বাংলাদেশের ব্যাটাররাও এদিন বেশ বেগ পায় ক্যারিবীয় স্পিনারদের বৈচিত্র্য সামলাতে। মাঝেমধ্যেই দেখা যায় বল ব্যাটের ফাঁক গলে স্টাম্পে লাগছে কিংবা ইনসাইড এজে শর্ট লেগে ক্যাচ যাচ্ছে।
অভিজ্ঞ স্যামির পরিকল্পনা সফল
ক্যারিবীয় কোচ ড্যারেন স্যামি নিজে একসময় বাংলাদেশের বিপক্ষে সফল বোলার ছিলেন। তাঁর পরিকল্পনাই মূলত এ ম্যাচে সাফল্যের ভিত গড়ে দেয়।
ম্যাচ শেষে তিনি বলেন,
“আমরা জানতাম এখানে পেসারদের জন্য কিছুই নেই। তাই স্পিনারদের পুরো আস্থা দিয়েছিলাম। তারা সেই আস্থা রাখতেও পেরেছে।”
বিশ্ব ক্রিকেটে এক নজিরবিহীন দৃশ্য
৫০ ওভারজুড়ে শুধু স্পিনার—এমন দৃশ্য ক্রিকেট বিশ্ব আগে দেখেনি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভক্তরাও রীতিমতো বিস্মিত। ক্রিকেট ইতিহাসবিদ রিচার্ড অ্যালান এক্স-এ লেখেন,
“এটা শুধু এক ম্যাচ নয়, বরং এক যুগের দৃষ্টান্ত। ওয়ানডে ক্রিকেটে নতুন কৌশলগত অধ্যায় সূচিত হলো।”
যে যুগে ক্রিকেটে গতির দাপট, সেখানে ওয়েস্ট ইন্ডিজের এই সাহসী স্পিন কৌশল যেন ব্যাটারদের জন্য এক নতুন চ্যালেঞ্জ হয়ে এল। ৫০ ওভার স্পিন—এটা শুধু পরিসংখ্যান নয়, বরং প্রমাণ যে ক্রিকেট এখনো কৌশলের খেলাই।
মিরপুরের এই ম্যাচ তাই শুধু জয়-পরাজয়ের হিসাব নয়, বরং ক্রিকেট ইতিহাসে থাকবে “স্পিনের শতভাগ ইনিংস” হিসেবে—যেখানে বলের প্রতিটি ডেলিভারিই ঘুরেছে, আর ইতিহাসও ঘুরে গেছে এক নতুন পথে।
