মিরপুরের সবুজ উইকেটে ঘূর্ণির জাদুতে আবারও হাসলো বাংলাদেশ। তরুণ লেগ স্পিনার রিশাদ হোসেনের ক্যারিয়ারসেরা বোলিং ফিগারে বিধ্বস্ত হয়েছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। তার দুর্দান্ত ৬ উইকেটের পারফরম্যান্সে ক্যারিবীয়রা মাত্র ১৩৯ রানে গুটিয়ে যায়। ২০৭ রানে অলআউট হওয়া বাংলাদেশের জয় আসে ৭৪ রানের বড় ব্যবধানে।
শনিবার (১৮ অক্টোবর) মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত ম্যাচে টস হেরে আগে ব্যাটিংয়ে নেমেছিল বাংলাদেশ দল। ব্যাটিংয়ে শুরুটা ছিল হতাশাজনক। ইনিংসের শুরুতেই ৮ রানে দুই ওপেনার সাইফ হাসান ও সৌম্য সরকারকে হারিয়ে ফেলে দল। কিন্তু পরে নাজমুল হোসেন শান্ত ও তাওহীদ হৃদয় দলকে সামলে তোলেন।
ধীর ব্যাটিংয়ে চাপে বাংলাদেশ, শেষ দিকে রিশাদের ঝড়
তিনে নামা শান্ত ৬৩ বলে ৩২ রান করেন, যার মধ্যে ছিল মাত্র দুটি বাউন্ডারি। অপরপ্রান্তে হৃদয় খেলেন আরও ধীরগতির ইনিংস—৯০ বলে ৫১ রান, তিনটি চারের শটে। অভিষিক্ত মাহিদুল ইসলাম অঙ্কন দেখিয়েছেন স্থিরতা, খেলেছেন ৭৬ বলে ৪৬ রানের পরিণত ইনিংস।
তবে মাঝ ও শেষের ওভারে ব্যাটারদের ব্যর্থতায় রান বাড়ানো কঠিন হয়ে পড়ে। নুরুল হাসান সোহান (৯), তানভীর ইসলাম (৯) দ্রুত ফেরেন। কিন্তু ইনিংসের শেষ দিকে দৃশ্যপটে আসেন রিশাদ।
মাত্র ১৩ বলে ২৬ রানের ঝোড়ো ইনিংস খেলেন তিনি—মারেন তিনটি বাউন্ডারি ও দুটি বিশাল ছক্কা। তার এই ছোট কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ইনিংসেই বাংলাদেশের স্কোর দাঁড়ায় ২০৭।
ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে জাইডেন সিলস ৭ ওভারে ৪৮ রান দিয়ে ৩ উইকেট নেন। পার্ট টাইম স্পিনার জাস্টিন গ্রেভস ৫ ওভারে ৩২ রানে ২টি উইকেট এবং অভিজ্ঞ স্পিনার রোস্টন চেজ ১০ ওভারে ৩০ রানে ২টি উইকেট শিকার করেন।
রিশাদের ম্যাজিক: একাই ভেঙে দেন ক্যারিবীয় ব্যাটিং লাইন
জবাবে ব্যাটিংয়ে নেমে শুরুটা ভালোই করেছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ওপেনার ব্রেন্ডন কিং ও আলিস আথানজে ৫১ রানের জুটি গড়েন। কিন্তু ১২তম ওভারে আক্রমণে এসে ম্যাচের গতিপথ ঘুরিয়ে দেন রিশাদ হোসেন। প্রথম বলেই ভেঙে দেন ওপেনিং জুটি, এরপর যেন তার ঘূর্ণিতে একে একে হারিয়ে যায় প্রতিপক্ষের প্রতিরোধ।
রিশাদ তুলে নেন আথানজে (২৭), কার্টি (৯), ব্রেন্ডন কিং (৪৪), রাদারফোর্ড (০), চেজ (৬) ও শেষ ব্যাটার সিলসকে (০)। ৯ ওভারে মাত্র ৩৫ রান দিয়ে ৬ উইকেট নেওয়ার এই পারফরম্যান্সে তিনি হয়ে যান ম্যাচের নিরঙ্কুশ নায়ক। এটি তার ক্যারিয়ারসেরা বোলিং ফিগার, একই সঙ্গে বাংলাদেশের ওয়ানডে ইতিহাসে তৃতীয় সেরা বোলিং রেকর্ড।
বাংলাদেশের পক্ষে এর আগে কেবল মাশরাফি বিন মুর্তজা (২০০৬, কেনিয়ার বিপক্ষে) এবং রুবেল হোসেন (২০১৩, নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে) ৬ উইকেট নিয়েছিলেন ২৬ রান দিয়ে। রিশাদের পরেই রয়েছেন মুস্তাফিজুর রহমান, যিনি ২০১৫ সালে ভারতের বিপক্ষে ৪৩ রানে ৬ উইকেট নিয়েছিলেন।
স্পিন ত্রয়ীর দাপট, ব্যাটসম্যানদের হার মানা
রিশাদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তানভীর ইসলাম নিয়েছেন ১ উইকেট, মেহেদী হাসান মিরাজ ১টি, আর মুস্তাফিজুর রহমান শিকার করেছেন ২টি উইকেট। ওয়েস্ট ইন্ডিজের ইনিংস গুটিয়ে যায় ৩৪.৪ ওভারে মাত্র ১৩৯ রানে।
ক্যারিবীয় ইনিংসে ব্রেন্ডন কিং একাই কিছুটা প্রতিরোধ গড়েন—৬০ বলে ৪৪ রান, পাঁচটি চার ও এক ছক্কায়। বাকি সবাই ব্যর্থ। অধিনায়ক শেই হোপ ১৫, রোমারিও শেইফার্ড ১, জাস্টিন গ্রেভস ১২, আর গুড়াকেশ মোতি ৩ রানে আউট হন।
ম্যাচ সেরা রিশাদ: “আমি আমার ছন্দ ফিরে পেয়েছি”
ম্যাচ শেষে ‘প্লেয়ার অব দ্য ম্যাচ’ পুরস্কার হাতে পেয়ে রিশাদ বলেন,
“এই পারফরম্যান্স আমার ক্যারিয়ারের জন্য দারুণ প্রেরণা। আমি জানতাম, উইকেটটা স্পিনারদের সহায়তা দেবে। শুধু ধৈর্য ধরে বল করতে চেয়েছি—ফল মিলেছে।”
তিনি আরও যোগ করেন, “টিম ম্যানেজমেন্ট সবসময় আমাকে আস্থা দিয়েছে। সেটাই আজ কাজে লেগেছে। সামনে আরও ভালো করতে চাই।”
টাইগারদের আত্মবিশ্বাসে নতুন জোয়ার
এই জয়ের মধ্য দিয়ে সিরিজে এগিয়ে গেল বাংলাদেশ। কোচ চন্দিকা হাতুরুসিংহে বলেছেন,
“রিশাদ আমাদের স্পিন আক্রমণের ভবিষ্যৎ। তার নিয়ন্ত্রিত লেগ স্পিন এবং আক্রমণাত্মক মনোভাব দলকে নতুন দিক দেখাচ্ছে।”
বাংলাদেশের এই জয়ে ওয়ানডে ফরম্যাটে তরুণদের আত্মবিশ্বাস আরও বেড়েছে। পরের ম্যাচে সিরিজ নিশ্চিত করার লক্ষ্যেই নামবে টাইগাররা।
স্কোর সংক্ষেপ:
বাংলাদেশ ৪৯.৪ ওভারে ২০৭ (অলআউট)
ওয়েস্ট ইন্ডিজ ১৩৯ (৩৯ ওভারে)
বাংলাদেশ জয়ী ৭৪ রানে।
ম্যাচসেরা: রিশাদ হোসেন (৬/৩৫)
