নেত্রকোণা জেলার দুর্গাপুর উপজেলায় উৎসবমুখর পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয়েছে হাজং সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী দেউলী উৎসব। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী কালচারাল একাডেমির আয়োজনে উপজেলার শ্যামনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে দিনব্যাপী এই আয়োজন অনুষ্ঠিত হয়।
দেউলী উৎসব হাজং জনগোষ্ঠীর অন্যতম প্রাচীন ঐতিহ্য, যা সামাজিক বন্ধন, ধর্মীয় রীতি ও সাংস্কৃতিক ঐক্যের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত। এবারের আয়োজনে নাচ-গান, পালা ও ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক পরিবেশনার মাধ্যমে উৎসব প্রাঙ্গণ মুখর হয়ে ওঠে।
‘৫ আগস্টের পর উৎসবের রাজনীতিকরণ কমেছে’ — মাহবুব মোর্শেদ
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান সম্পাদক মাহবুব মোর্শেদ।
তিনি বলেন, “দেউলী উৎসবসহ বাংলাদেশের নানা ধর্ম ও সম্প্রদায়ের উৎসবগুলো আজ স্বাধীনভাবে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের পর আমরা এমন এক সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, যখন ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই নিজের ঐতিহ্য পালন করতে পারছে, কোনো রাজনীতিকরণের ভয় ছাড়াই।”
তিনি আরও বলেন, “এটা আমাদের একটি বড় অর্জন। এই ধারা যেন অব্যাহত থাকে—যারা আগামী দিনে সরকার গঠন করবেন, তারা যেন বহু সংস্কৃতির এই ঐতিহ্যকে ধারণ করেন এবং কোনো জাতি বা ধর্মের উৎসবকে সংকুচিত না করেন।”
দুর্গাপুরের সম্ভাব্য সংসদ সদস্য প্রার্থী ব্যারিস্টার কায়সার কামালের প্রতি আহ্বান জানিয়ে মাহবুব মোর্শেদ বলেন, “আপনি যদি নির্বাচিত হন, তবে হাজং ও মান্দি জনগোষ্ঠীর উৎসবগুলোকে আরও ব্যাপকভাবে আয়োজনের সুযোগ দিন। এ অঞ্চল সংগ্রামী ইতিহাসে ভরপুর—ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত এই মাটি ঐতিহ্যবাহী ও সম্ভাবনাময়।”
তিনি আরও উল্লেখ করেন, “দুর্গাপুরের সোমেশ্বরী নদী ও গারো পাহাড় এই অঞ্চলের সম্পদ। কৃষি, পর্যটন ও সংস্কৃতি—তিন ক্ষেত্রেই এখানে অসীম সম্ভাবনা রয়েছে, যা কাজে লাগাতে পারলে এ এলাকা জাতীয় অর্থনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারবে।”
‘দুর্গাপুর হলো নানা ফুলে ভরা এক বাগান’ — ব্যারিস্টার কায়সার কামাল
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) আইনবিষয়ক সম্পাদক, জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের মহাসচিব এবং দুর্গাপুর-কলমাকান্দা আসনের বিএনপি মনোনীত প্রার্থী ব্যারিস্টার কায়সার কামাল।
তিনি তার বক্তব্যে বলেন, “আমাদের দুর্গাপুর ও কলমাকান্দা একটি সুন্দর বাগানের মতো—যেখানে হিন্দু, মুসলিম, গারো, হাজং—সবাই একেকটি ফুল। আমি চেষ্টা করছি এই বাগানের একজন মালি হতে, যেন এই সৌন্দর্য ও ঐক্য অটুট থাকে।”
তিনি বলেন, “শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের উদ্যোগে কালচারাল একাডেমি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে যে সাংস্কৃতিক বন্ধন তৈরি হয়েছিল, সেটি আমাদের সমাজে ধর্ম-বর্ণের ভেদাভেদ দূর করেছে। সেই চেতনাকে আরও এগিয়ে নিতে হবে।”
তার ভাষায়, “হাজং ও মান্দি সম্প্রদায়ের জীবনমান উন্নয়নে কৃষি, শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা এখন সময়ের দাবি। এই অঞ্চলে ছোট শিল্পকারখানা ও পর্যটনকেন্দ্র স্থাপনের মাধ্যমে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটানো সম্ভব।”
সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের রঙে রাঙা দিন
অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করেন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী কালচারাল একাডেমির পরিচালক কবি পরাগ রিছিল।
উৎসবের উদ্বোধন করেন আদিবাসী নেতা মতিলাল হাজং।
অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন দুর্গাপুর উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. মিজানুর রহমান, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ এ্যাডভোকেট এম.এ জিন্নাহ, সংস্কৃতি কর্মী আব্দুল্লাহ আল মামুন মুকুল, একাডেমির নির্বাহী পরিষদের সদস্য সন্ধ্যা রানী হাজং, বাংলাদেশ জাতীয় হাজং সংগঠনের সভাপতি পল্টন হাজং, এবং শ্যামনগর গ্রামের প্রতিনিধি সজল হাজং প্রমুখ।
দিনব্যাপী অনুষ্ঠানে হাজং সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী সংগীত, নৃত্য ও পালাগান পরিবেশিত হয়। বিশেষভাবে আকর্ষণীয় ছিল ‘মহিষাসুর বধ’ পালা, যা দর্শকদের ব্যাপক প্রশংসা কুড়ায়।
ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা রক্ষার অঙ্গীকার
দেউলী উৎসব শুধু আনন্দ ও বিনোদনের আয়োজন নয়, বরং হাজং জনগোষ্ঠীর ইতিহাস, ধর্মীয় বিশ্বাস ও ঐতিহ্য সংরক্ষণের এক গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ভিত্তি।
স্থানীয় জনগণ ও অতিথিদের মতে, এমন আয়োজনের মধ্য দিয়ে জাতিগত সম্প্রীতি, সহাবস্থান ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের ধারাবাহিকতা আরও সুদৃঢ় হবে।










সত্যের সন্ধানে আমরা — NRD News Media Limited