উত্তরবঙ্গের প্রাণ তিস্তা নদী। অথচ সেই তিস্তা আজ শুকিয়ে যাওয়া বালুচর, ভাঙন আর মরুরূপে পরিণত হয়েছে। বর্ষায় ভয়াবহ বন্যা আর শুষ্ক মৌসুমে পানিশূন্য খরায় বিপর্যস্ত তিস্তাপাড়ের মানুষ। এমন বাস্তবতায় তিস্তা নদীর পুনরুজ্জীবন ও তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের দাবিতে এখন উত্তাল রংপুর বিভাগ।
এই দাবিকে কেন্দ্র করে আগামী ৩০ অক্টোবর বৃহস্পতিবার ‘স্তব্ধ রংপুর’ কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দিয়েছে তিস্তা নদী রক্ষা আন্দোলন কমিটি। এই কর্মসূচির আওতায় রংপুর বিভাগের লালমনিরহাট, রংপুর, নীলফামারী, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধা— পাঁচটি জেলায় একযোগে ১৫ মিনিটের জন্য সব ধরনের কাজ বন্ধ থাকবে।
কর্মসূচি অনুযায়ী, বেলা ১১টা থেকে ১১টা ১৫ মিনিট পর্যন্ত শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কৃষক-শ্রমিক, ব্যবসায়ী, দোকানদার, ক্রেতা-বিক্রেতা, পরিবহন চালক, কর্মকর্তা-কর্মচারী— সবাই নিজ নিজ অবস্থান থেকে কাজ বন্ধ রেখে নীরবে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ জানাবেন।
যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকবে ১৫ মিনিট। স্কুল, কলেজ ও অফিসেও থাকবে নীরবতা। এই সময়ে তিস্তা বাঁচানোর দাবি জানিয়ে একযোগে প্রতিধ্বনিত হবে উত্তরবঙ্গের কণ্ঠ— “তিস্তা বাঁচলে উত্তরবঙ্গ বাঁচবে, তিস্তা বাঁচলেই বাংলাদেশ বাঁচবে।”
আন্দোলনের ডাক দিচ্ছেন অধ্যক্ষ আসাদুল হাবিব দুলু
তিস্তা নদী রক্ষা আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক ও বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির রংপুর বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক অধ্যক্ষ আসাদুল হাবিব দুলু জানান, এই কর্মসূচি উত্তরাঞ্চলের দুই কোটি মানুষের অস্তিত্ব রক্ষার আন্দোলন।
তিনি বলেন,
“তিস্তা শুধু একটি নদী নয়— এটি আমাদের জীবন, জীবিকা ও সংস্কৃতির প্রতীক। সরকার যদি আগামী নভেম্বরের মধ্যে নিজস্ব অর্থায়নে তিস্তা মহাপরিকল্পনার কাজ শুরু না করে, তবে আমরা বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তুলব। গোটা উত্তরাঞ্চলকে অচল করে দেওয়া হবে।”
পূর্ববর্তী কর্মসূচি ও আন্দোলনের ধারাবাহিকতা
এর আগে তিস্তা রক্ষা আন্দোলনের অংশ হিসেবে গত ১৭ ও ১৮ ফেব্রুয়ারি তিস্তার তীরে ১১টি পয়েন্টে লাখো মানুষ অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন।
৫ অক্টোবর জেলা প্রশাসকদের মাধ্যমে প্রধান উপদেষ্টার কাছে স্মারকলিপি পাঠানো হয় এবং ৯ অক্টোবর উপজেলা শহরগুলোতে গণমিছিল অনুষ্ঠিত হয়।
সবশেষ ১৬ অক্টোবর সন্ধ্যায় তিস্তার দুই তীরে ১৩০ কিলোমিটারজুড়ে মশাল প্রজ্জ্বলন কর্মসূচি পালন করে লাখো মানুষ।
সেই কর্মসূচিতে তিস্তা পাড় জুড়ে প্রতিধ্বনিত হয় স্লোগান—
“জাগো বাহে, তিস্তা বাঁচাই”,
“তিস্তার ন্যায্য হিস্যা চাই”,
“তিস্তা মহাপরিকল্পনার কাজ বাস্তবায়ন চাই।”
এই ধারাবাহিক আন্দোলনই এখন গতি পেয়েছে ‘স্তব্ধ রংপুর’ কর্মসূচিতে।
মানুষের প্রত্যাশা— জীবন বদলাবে তিস্তা খননে
রংপুর বিভাগের বিভিন্ন এলাকার মানুষ জানিয়েছেন, তিস্তা খনন ও নদী পুনর্গঠন হলে উত্তরাঞ্চলের চিত্র পাল্টে যাবে। সেচব্যবস্থা উন্নত হবে, কৃষি উৎপাদন বাড়বে এবং বন্যা-খরার ভয় কমবে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে পুরো উত্তরবঙ্গ হবে খাদ্যশস্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি অঞ্চল, যেখানে কর্মসংস্থানও উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাবে।
তিস্তা পাড়ের কৃষক আজিজুল হক বলেন,
“আমরা কষ্টে বাঁচি। বর্ষায় সব ডুবে যায়, আর শীতে পানি থাকে না। যদি তিস্তা খনন হয়, আমরা আবারও ফসল ফলাতে পারব, আমাদের সন্তানদের মুখে হাসি ফিরবে।”
পেছনের ইতিহাস ও ভবিষ্যৎ আশাবাদ
তিস্তা নদীর উৎপত্তি হিমালয় থেকে। এটি বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের জীবনরেখা হিসেবে বিবেচিত। কিন্তু ভারতের গজলডোবা ব্যারাজ নির্মাণের পর থেকে এ নদীর পানিপ্রবাহ উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে।
বাংলাদেশ সরকার তিস্তা নদীর খনন ও পুনঃসংযোগের জন্য তিস্তা মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে, যা বাস্তবায়িত হলে প্রায় ১২ লাখ হেক্টর জমি সেচ সুবিধা পাবে।
তবে দীর্ঘদিন ধরে প্রকল্পটি কেবল কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ থাকায় স্থানীয় মানুষের ক্ষোভ চরমে উঠেছে।
‘স্তব্ধ রংপুর’— এক ঐক্যের প্রতীক
আগামী ৩০ অক্টোবরের এই ‘স্তব্ধ রংপুর’ কর্মসূচি কেবল একটি আন্দোলন নয়; এটি তিস্তাপাড়ের মানুষের একতার প্রতীক। এই ১৫ মিনিটের নীরবতা হবে দুই কোটি মানুষের সম্মিলিত আর্তনাদ, যা সরকারের কর্ণকুহরে পৌঁছাতে চায়।
অধ্যক্ষ দুলুর ভাষায়—
“এটি কেবল আন্দোলন নয়, এটি আমাদের বেঁচে থাকার লড়াই। তিস্তা বাঁচলেই উত্তরবঙ্গ বাঁচবে, আর তিস্তা বাঁচলেই বাংলাদেশ বাঁচবে।”










সত্যের সন্ধানে আমরা — NRD News Media Limited