ভারী বৃষ্টি ও উজানের ঢলে উত্তরের জেলাগুলোতে ফের দেখা দিয়েছে বন্যা। তিস্তা নদীর পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করায় রংপুর, লালমনিরহাট, নীলফামারী ও কুড়িগ্রামের নদীসংলগ্ন নিম্নাঞ্চল ডুবে গেছে। হাজারো মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে উঁচু স্থানে আশ্রয় নিয়েছেন।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানিয়েছে, সোমবার সকাল থেকে তিস্তার পানি কিছুটা কমলেও তা এখনও বিপৎসীমার ওপরে। আগামী তিন দিনের মধ্যে পানি ধীরে ধীরে নামতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে। তবে নতুন করে বৃষ্টির সম্ভাবনায় পরিস্থিতি আবারও জটিল হতে পারে।
গত রোববার রাতে দেশের সর্ববৃহৎ সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে পানির উচ্চতা বিপৎসীমার ৩৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। ফলে রংপুরের গঙ্গাচড়া ও কাউনিয়া, লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা ও কালীগঞ্জ, এবং কুড়িগ্রামের চিলমারী ও উলিপুরের নিম্নাঞ্চলে পানি ঢুকে পড়ে।
গঙ্গাচড়ায় চার হাজার পরিবার পানিবন্দি
তিস্তার পানি বেড়ে যাওয়ায় রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার ৭ ইউনিয়নের প্রায় চার হাজার পরিবার এখন পানিবন্দি। অনেকে গবাদিপশু ও গৃহস্থালির মালপত্র নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন স্কুল, মসজিদ বা উঁচু বাঁধে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাহমুদ হাসান মৃধা জানান, পানিবন্দি পরিবারগুলোর জন্য ইতোমধ্যে ১২ টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
রোববার রাতে পানি উন্নয়ন বোর্ড আগাম সতর্কবার্তা দিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে মাইকিং করলেও অনেকেই সময়মতো সরতে পারেননি। নোহালী, আলমবিদিতর, কোলকোন্দ, লক্ষ্মীটারী ও গজঘণ্টা ইউনিয়নের বড় অংশ এখনো ডুবে আছে।
রংপুরে হঠাৎ ঝড়ে সাত শতাধিক ঘর বিধ্বস্ত
বন্যার পাশাপাশি রোববার সকাল থেকে টানা বৃষ্টি ও আকস্মিক ঝড়ে রংপুরের গঙ্গাচড়া, আলমবিদিতর ও নোহালী ইউনিয়নে সাত শতাধিক ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। টিনশেড ঘর ভেঙে পড়েছে, গাছ উপড়ে গেছে, বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন।
স্থানীয় প্রশাসন ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ৮ টন চাল বরাদ্দ করেছে এবং শুকনো খাবার বিতরণ শুরু হয়েছে।
লালমনিরহাটে প্লাবিত পাঁচ হাজার পরিবার
লালমনিরহাটের পাটগ্রাম, হাতীবান্ধা, কালীগঞ্জ, আদিতমারী ও সদর উপজেলার বহু নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। পাউবো জানিয়েছে, ভাঙন ঠেকাতে জরুরি প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।
জেলা প্রশাসক এইচ এম রকিব হায়দার বলেন, “ত্রাণ ও শুকনো খাবারের পর্যাপ্ত মজুত রয়েছে। আমরা প্রতিটি উপজেলায় সরবরাহ নিশ্চিত করছি।”
নদীজুড়ে ভেসে আসছে গাছ, নিখোঁজ ১
কুড়িগ্রামের চিলমারী, নাগেশ্বরী ও ভুরুঙ্গামারীতে ব্রহ্মপুত্র ও দুধকুমার নদে ভেসে আসছে হাজার হাজার গাছের গুঁড়ি। স্থানীয়রা নৌকা ও দড়ি দিয়ে গাছ সংগ্রহ করছেন। ধারণা করা হচ্ছে, ভুটানের কালজানী ও ভারতের হাসিমারা বনাঞ্চল থেকে স্রোতের টানে এসব গাছ এসেছে।
গাছ তুলতে গিয়ে নাগেশ্বরীর মনছুর আলী (৪০) পানিতে ডুবে নিখোঁজ হয়েছেন। স্থানীয় চেয়ারম্যান ইউসুফ আলী বলেন, “নদীজুড়ে শুধু গাছ আর গাছ, এমন দৃশ্য জীবনে দেখি নাই।”
দিনাজপুরে ধান ও সবজির ক্ষতি
টানা বৃষ্টিতে দিনাজপুরের ফুলবাড়ীতে আগাম আমন, আলু ও শীতকালীন সবজির খেতে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সাইফ আব্দুল্লাহ বলেন, “জলাবদ্ধতায় পাকা ধানের ক্ষতি হয়েছে। পানি নেমে গেলে পরিস্থিতি কিছুটা উন্নত হবে।”
লালমনিরহাটের দহগ্রামে তিস্তার পানির তোড়ে একটি সেতু ও দুটি কালভার্ট ভেঙে গেছে। প্রায় ১০ হেক্টর ফসলি জমি তলিয়ে গেছে, ৭ কিলোমিটার রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
বৃষ্টিপাত রেকর্ড ও পূর্বাভাস
গতকাল সোমবার পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় ১৩৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়। আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, আগামী তিন দিন দেশের উত্তরাঞ্চল ও ভারতের উজানে মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে।
প্রতিনিয়ত নদীপাড়ের মানুষের জীবন এখন বন্যার সঙ্গে লড়াই। ফসল হারানো কৃষক, গৃহহীন পরিবার আর ত্রাণের অপেক্ষায় থাকা মানুষদের পাশে দাঁড়াতে প্রশাসন ও স্বেচ্ছাসেবীরা মাঠে নেমেছে।
তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের জন্য নদী খনন, বাঁধ রক্ষণাবেক্ষণ ও সঠিক পূর্বাভাস ব্যবস্থার ওপর এখন জোর দেওয়া জরুরি।
