উজানের ঢল আর টানা বৃষ্টিতে তিস্তা নদীর পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করায় রংপুর, লালমনিরহাট, নীলফামারী ও কুড়িগ্রামে ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। নদী তীরবর্তী নিম্নাঞ্চলগুলোতে ঢুকে পড়েছে নদীর পানি। হাজার হাজার পরিবার এখন পানিবন্দি, ডুবে গেছে রোপা আমন, সবজি, বাদাম ও মাসকলাইয়ের ক্ষেত।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানিয়েছে, গতকাল সোমবার সকাল থেকে তিস্তা নদীর পানি কিছুটা কমলেও তা এখনও বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। আগামী তিন দিনে তিস্তা, ধরলা ও দুধকুমার নদীর পানি ধীরে ধীরে কমতে পারে। ফলে বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতির সম্ভাবনা রয়েছে।
রেড অ্যালার্ট জারি ও তিস্তার তাণ্ডব
গত রোববার রাতে তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে পানির উচ্চতা বিপৎসীমার (৫২.১৫ সেন্টিমিটার) ৩৬ সেন্টিমিটার ওপরে চলে যায়। এতে পানি উন্নয়ন বোর্ড রেড অ্যালার্ট জারি করে।
রাতের মধ্যেই রংপুরের গঙ্গাচড়া, কাউনিয়া, লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রামের নিম্নাঞ্চলগুলোতে পানি ঢুকে পড়ে।
যদিও গতকাল সন্ধ্যায় তিস্তার পানি কমতে শুরু করে—সন্ধ্যা ৬টার দিকে বিপৎসীমার ২৫ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়। কিন্তু এর মধ্যেই ক্ষয়ক্ষতি ঘটে গেছে। গঙ্গাচড়ার নদীবেষ্টিত ৭ ইউনিয়নের প্রায় চার হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।
গৃহস্থালি জিনিসপত্র, আসবাব ও গবাদি পশু নিয়ে অনেক পরিবার আশ্রয় নিয়েছে উঁচু স্থানে বা বাঁধের ওপর। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাইকিং করে আগেই সতর্ক করা হলেও অনেকেই পানিবন্দি হয়ে পড়েন।
গঙ্গাচড়ার ইউএনও মাহমুদ হাসান মৃধা বলেন, “পানিবন্দি পরিবারগুলোর জন্য ১২ টন চাল বিতরণ করা হয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রে শুকনো খাবার ও বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা করা হয়েছে।”
রংপুরে ঝড়-বৃষ্টিতে ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত
রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার আলমবিদিতর ও নোহালী ইউনিয়নে হঠাৎ ঝড় ও ভারী বৃষ্টিতে সাত শতাধিক ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। টিনশেড ও আধাপাকা ঘর ভেঙে পড়েছে, শত শত গাছ উপড়ে গেছে।
ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর পাশে দাঁড়িয়েছে স্থানীয় প্রশাসন। তারা জানিয়েছে, ৮ টন চাল বরাদ্দ এবং শুকনো খাবার বিতরণ শুরু হয়েছে।
স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা ভেজা বই-খাতা শুকানোর চেষ্টা করছে, অনেকে খোলা জায়গায় রান্না করছেন—এমন চিত্র এখন রংপুরের গ্রামীণ এলাকায় সাধারণ দৃশ্য।
লালমনিরহাটে পাঁচ হাজার পরিবার পানিবন্দি
লালমনিরহাট জেলার পাটগ্রাম, হাতীবান্ধা, কালীগঞ্জ, আদিতমারী ও সদর উপজেলার বিভিন্ন নিম্নাঞ্চল ডুবে গেছে।
প্রায় পাঁচ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক এইচ এম রকিব হায়দার। তিনি বলেন, “পর্যাপ্ত ত্রাণ ও শুকনো খাবার মজুত রয়েছে, প্রয়োজনে আরও সরবরাহ করা হবে।”
পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী সুনীল কুমার জানান, নদী ভাঙন ঠেকাতে জরুরি ভিত্তিতে প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে এবং ঝুঁকিপূর্ণ পয়েন্টগুলোতে বাঁধ মেরামতের কাজ চলছে।
কুড়িগ্রামের নদীজুড়ে ভেসে আসছে হাজারো গাছ
কুড়িগ্রামের চিলমারী, নাগেশ্বরী ও ভুরুঙ্গামারী উপজেলার ব্রহ্মপুত্র ও দুধকুমার নদীতে ভেসে আসছে হাজারো গাছের গুঁড়ি। স্থানীয়রা নৌকা ও দড়ি ব্যবহার করে গাছগুলো তুলছেন।
ধারণা করা হচ্ছে, এসব গাছ ভারতের হাসিমারা ও ভুটানের কালজানী বনাঞ্চল থেকে স্রোতের তোড়ে ভেসে এসেছে।
গাছ তুলতে গিয়ে নাগেশ্বরীর মনছুর আলী (৪০) নামে এক ব্যক্তি নদীতে ডুবে নিখোঁজ হয়েছেন। স্থানীয় চেয়ারম্যান ইউসুফ আলী বলেন, “নদীজুড়ে শুধু গাছ আর গাছ। জীবনে এমন দৃশ্য দেখিনি।”
কৃষিক্ষেত্রে বড় ক্ষতি
দিনাজপুরের ফুলবাড়ীতে টানা বৃষ্টিতে আগাম আমন ধান, আলু ও শীতকালীন সবজি ব্যাপক ক্ষতির মুখে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সাইফ আব্দুল্লাহ বলেন, “জলাবদ্ধতায় কিছু এলাকায় পাকা ধান নষ্ট হয়েছে। পানি নামলে পরিস্থিতি উন্নতি হবে।”
লালমনিরহাটের দহগ্রাম ইউনিয়নের অন্তত ১০টি এলাকা প্লাবিত হয়েছে। পানির তোড়ে ৭ কিলোমিটার রাস্তা, একটি সেতু ও দুটি কালভার্ট ভেঙে গেছে। ডুবে গেছে ১০ হেক্টর আমন ও বাদামের ক্ষেত।
আরও বৃষ্টির আশঙ্কা
পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় গত ২৪ ঘণ্টায় ১৩৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, আগামী তিন দিন দেশের উত্তরাঞ্চল ও ভারতের উজানে মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। এতে তিস্তা ও ধরলা অববাহিকার নিম্নাঞ্চলে পুনরায় বন্যার ঝুঁকি দেখা দিতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উত্তরাঞ্চলে তিস্তা ও তার শাখানদীগুলোর পানিপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণে একটি দীর্ঘমেয়াদি সমন্বিত পদক্ষেপ এখন সময়ের দাবি। অন্যথায় প্রতিবছর এমন বন্যা পরিস্থিতি মানুষের জীবিকা, কৃষি ও অবকাঠামোর ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলবে।
