যেভাবে গড়ে উঠলো জাতীয় সংসদ ভবন: এক স্থাপত্যশৈলীর ইতিহাস
বাংলাদেশের গর্ব জাতীয় সংসদ ভবন
স্থাপত্যশৈলী, নান্দনিকতা ও ইতিহাসের সমন্বয়ে বাংলাদেশের যে ক’টি স্থাপনা বিশ্বমঞ্চে স্থান করে নিয়েছে, জাতীয় সংসদ ভবন তাদের অন্যতম। ঢাকার শেরেবাংলা নগরে অবস্থিত এই ভবন শুধু একটি আইনসভা নয়, এটি বাংলাদেশের গৌরবময় পরিচয়ের প্রতীক।
দ্বিতীয় রাজধানী থেকে সংসদ ভবনের পরিকল্পনা
১৯৫০ ও ৬০-এর দশকে পাকিস্তান সরকার পূর্ব পাকিস্তানে দ্বিতীয় রাজধানী স্থাপনের পরিকল্পনা করে। রাজধানীর জন্য বেছে নেওয়া হয় ঢাকার শেরেবাংলা নগর এলাকা, যার নাম দেওয়া হয়েছিল আইয়ুব নগর।
পরিকল্পনার অংশ হিসেবে প্রস্তাব করা হয় একটি পূর্ণাঙ্গ প্রশাসনিক শহর নির্মাণের, যেখানে থাকবে জাতীয় পরিষদ ভবন, সুপ্রিম কোর্ট, জনপ্রতিনিধি ও সরকারি কর্মচারীদের আবাসন, এমনকি প্রেসিডেন্ট ভবন ও হাসপাতালও।
বাংলাদেশের স্থপতি মাজহারুল ইসলাম এই মহাপরিকল্পনায় তিনজন বিশ্বখ্যাত স্থপতির নাম প্রস্তাব করেন—ল্য করব্যুজিয়ে, আলভার আইতো এবং লুই আই কান। শেষ পর্যন্ত দায়িত্ব পান লুই আই কান।
লুই আই কানের নকশা ও স্বপ্ন
১৯৬২ সালে ঢাকা সফরে এসে লুই কান প্রকৃতি, আলোছায়া এবং স্থানিক বৈচিত্র্য পর্যবেক্ষণ করেন। বাংলার লাল ইট, নদী ও সবুজ প্রকৃতি তাঁকে অনুপ্রাণিত করে। তাঁর নকশায় আধুনিকতা ও ঐতিহ্যের এক অসাধারণ সমন্বয় ফুটে ওঠে।
১৯৬৩ সালে প্রথম মাস্টারপ্ল্যান জমা দেওয়ার পর বিভিন্ন পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে ১৯৭৩ সালে চূড়ান্ত রূপ পায় জাতীয় সংসদ ভবন। যদিও কানের মূল পরিকল্পনায় আরও বৃহত্তর একটি শহরের ধারণা ছিল, বাস্তবে তা পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি।
সংসদ ভবনের স্থাপত্যশৈলীর বৈশিষ্ট্য
অষ্টভুজ কেন্দ্রীয় হলরুম – সংসদ সদস্যদের আইন প্রণয়নের মূল স্থান।
আটটি সংলগ্ন ব্লক – উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিমের চারদিকে রয়েছে অফিস ও প্রশাসনিক কক্ষ।
নামাজঘর – দক্ষিণমুখী বিশাল নামাজ ঘর, যার চার কোণায় ফাঁপা কলাম ও প্রাকৃতিক আলো-বাতাস প্রবাহের ব্যবস্থা।
দক্ষিণ ও উত্তর প্লাজা – দক্ষিণ প্লাজা লাল ইটে নির্মিত, যেখানে ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়। উত্তর প্লাজা ও প্রেসিডেন্টস প্লাজা মার্বেল পাথরে শোভিত।
ভবনের চারপাশে বিস্তৃত লেক ও সবুজ প্রাকৃতিক পরিবেশ ভবনটিকে পানির ওপর ভেসে থাকা এক অনন্য স্থাপত্যে রূপ দিয়েছে।
বিশ্বে স্বীকৃতি
জাতীয় সংসদ ভবন শুধু বাংলাদেশের নয়, বিশ্ব স্থাপত্যের এক অনন্য নিদর্শন। আধুনিক স্থাপত্যশৈলী ও স্থানিক বিন্যাসের কারণে এটি আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত। বিশ্বের স্থপতি, গবেষক ও শিক্ষার্থীরা আজও এর নকশা অধ্যয়ন করে থাকেন।
বাংলাদেশের গর্বের প্রতীক
স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে জাতীয় সংসদ ভবন শুধু একটি স্থাপনা নয়, এটি মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী রাষ্ট্রগঠনের প্রতীক। আজকের দিনে সংসদ ভবন কেবল রাজনীতির কেন্দ্র নয়, এটি বাংলাদেশের সংস্কৃতি, ইতিহাস ও পরিচয়ের গৌরবময় নিদর্শন।
