বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের প্রাণ তিস্তা নদী এখন প্রায় মৃতপ্রায়। একসময় স্রোতস্বিনী এই নদী আজ পরিণত হয়েছে ধু-ধু বালুচরে। বর্ষা শেষে শুকিয়ে যাওয়া তিস্তায় এখন দেখা যায় ফেটে যাওয়া তলদেশ, বালুচর আর অল্প কিছু অগভীর জলাশয়। ফলে থমকে গেছে কৃষি, সেচ এবং জীবিকার চক্র—হুমকির মুখে পড়েছে উত্তরাঞ্চলের জনজীবন।
প্রবাহ কমেছে অর্ধেকে, তলদেশে জমছে পলি
পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তথ্য অনুযায়ী, গত ১১ দিনে তিস্তা ব্যারেজ পয়েন্টে গড়ে পানি প্রবাহ ছিল মাত্র ১৭ হাজার কিউসেক, যা স্বাভাবিক প্রবাহের তুলনায় অর্ধেকেরও কম।
নদীর গভীরতা প্রায় অর্ধেকে নেমে গেছে; অনেক স্থানে তলদেশ ভরাট হয়ে নদী শুকিয়ে যাচ্ছে। এর ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তরও নেমে যাচ্ছে, যা শুষ্ক মৌসুমে কৃষি ও পানির সরবরাহে ভয়াবহ প্রভাব ফেলছে।
রংপুর, নীলফামারী, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধার কৃষকরা বলছেন, তিস্তায় পানি না থাকায় সেচ বন্ধ হয়ে গেছে। মাঠের ধান, ভুট্টা, পাট, তিলসহ নানা ফসল অপরিপক্ক অবস্থায় শুকিয়ে যাচ্ছে রোদে। রবি মৌসুমে সেচব্যবস্থা প্রায় ভেঙে পড়বে বলে আশঙ্কা করছেন স্থানীয় কৃষক ও কর্মকর্তারা।
“তিস্তা মরে গেলে উত্তরবঙ্গ মরবে” — গবেষক ড. তুহিন ওয়াদুদ
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তিস্তার মূল তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়ায় পানির প্রবাহ ব্যাহত হচ্ছে। একমাত্র নদী পুনঃখননই হতে পারে এর স্থায়ী সমাধান।
রংপুরের নদী গবেষক ড. তুহিন ওয়াদুদ সতর্ক করে বলেন,
“বিজ্ঞানসম্মতভাবে তিস্তা পুনঃখনন না হলে উত্তরাঞ্চল ক্রমে মরুভূমিতে পরিণত হবে। এতে শুধু কৃষি নয়, মানুষের জীবন ও সংস্কৃতিও হুমকির মুখে পড়বে।”
তিনি আরও বলেন, “তিস্তাকে বাঁচানো মানে উত্তরবঙ্গের অর্থনীতি, খাদ্যনিরাপত্তা ও পরিবেশকে টিকিয়ে রাখা।”
বর্ষায় উল্টো চিত্র—তীব্র ভাঙন ও প্লাবন
তিস্তায় শুকনো মৌসুমে পানি না থাকলেও বর্ষায় চিত্র ভিন্ন। তখন ভারত থেকে নেমে আসা ঢলের পানিতে তীব্র স্রোতে উছলে ওঠে নদী। সেই প্রবল স্রোতে নদীভাঙনে তিস্তা তীরবর্তী হাজারো পরিবার বাস্তুচ্যুত হয়—তলিয়ে যায় বসতবাড়ি, ফসল ও গবাদিপশু।
পাউবোর তথ্যমতে, গত এক দশকে তিস্তা নদীর ভাঙনে ২০ হাজারেরও বেশি পরিবার উচ্ছেদ হয়েছে।
রাজারহাট, গঙ্গাচড়া ও উলিপুর অঞ্চলে অন্তত ৩৫ কিলোমিটার এলাকায় ভয়াবহ ভাঙন দেখা দিয়েছে।
লালমনিরহাটের মহিপুর এলাকায় তিস্তা সেতু রক্ষা বাঁধের প্রায় ৩৫০ মিটার অংশ নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।
পাঁচ জেলায় চলছে ‘তিস্তা বাঁচাও’ আন্দোলন
এই সংকট ঘিরে এখন তিস্তাপাড়ে জেগে উঠেছে প্রতিবাদ ও সচেতনতার ঢেউ।
‘তিস্তা বাঁচাও, উত্তরবঙ্গ বাঁচাও’ স্লোগানকে সামনে রেখে রংপুর বিভাগের পাঁচ জেলা—নীলফামারী, রংপুর, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধায়—মানববন্ধন, অবস্থান কর্মসূচি ও সমাবেশ চলছে।
স্থানীয় বাসিন্দা ও পরিবেশবাদীরা বলছেন,
“তিস্তা শুধু একটি নদী নয়, এটি আমাদের জীবন ও সংস্কৃতির প্রতীক। নদীটি মরে গেলে হারাবে কৃষি, হারাবে আমাদের অস্তিত্ব।”
তিস্তা মহাপরিকল্পনা: আশার আলো
পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান জানিয়েছেন,
“২০২৬ সালের জানুয়ারিতে তিস্তা মহাপরিকল্পনার কাজ শুরু হবে। প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকার এই প্রকল্পে চীন দেবে ৬ হাজার ৭০০ কোটি টাকার ঋণ সহায়তা।”
এই প্রকল্পে তিস্তাকে পুনঃখনন, নদী ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন, বাঁধ সংস্কার, সেচ ব্যবস্থার আধুনিকীকরণ এবং নদীভাঙন রোধের পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রকল্পটি দ্রুত ও পরিবেশবান্ধব উপায়ে বাস্তবায়িত হলে উত্তরবঙ্গের কৃষি ও অর্থনীতি আবারও সচল হতে পারে।
তিস্তায় প্রাণ ফিরলে বাঁচবে উত্তরবঙ্গ
তিস্তা এখন শুধু একটি নদীর সংকট নয়—এটি একটি অঞ্চলের টিকে থাকার সংগ্রাম। নদী শুকিয়ে গেলে যেমন কৃষি ও জীবিকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তেমনি অতিবৃষ্টিতে ভাঙন ও ক্ষয়ক্ষতিও ভয়াবহ রূপ নেয়।
তাই বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তিস্তার জন্য প্রয়োজন সমন্বিত নদী ব্যবস্থাপনা, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণ।
নদী বাঁচলে কৃষি বাঁচবে, আর কৃষি বাঁচলে বাঁচবে উত্তরবঙ্গের প্রাণ—তিস্তাপাড়ের মানুষের এই প্রত্যাশাই এখন সবচেয়ে বড় দাবি।











সত্যের সন্ধানে আমরা — NRD News Media Limited