জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে (এনএইচআরসি) প্রকৃত অর্থে স্বাধীন, কার্যকর ও জনগণের আস্থার প্রতীক হিসেবে গড়ে তুলতে নতুন জাতীয় মানবাধিকার কমিশন অধ্যাদেশ অনুমোদন করেছে উপদেষ্টা পরিষদ।
আজ বৃহস্পতিবার প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত উপদেষ্টা পরিষদের সভায় এই অধ্যাদেশের অনুমোদন দেওয়া হয়। বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস।
বৈঠক শেষে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল। তিনি জানান, এই নতুন আইন মানবাধিকার কমিশনকে “দন্তহীন প্রতিষ্ঠান” থেকে “ক্ষমতাসম্পন্ন, জবাবদিহিমূলক ও কার্যকর” সংস্থায় রূপান্তর করবে।
পুরনো কমিশনের সীমাবদ্ধতা দূর হচ্ছে
আইন উপদেষ্টা বলেন,
“আমাদের আগে একটা মানবাধিকার কমিশন ছিল, কিন্তু সেটি কার্যত দন্তহীন ছিল। নিয়োগ পদ্ধতিতে ত্রুটি, এখতিয়ারে ঘাটতি এবং নেতৃত্বের দুর্বলতায় প্রতিষ্ঠানটি কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি। এবার সেটিকে সত্যিকারের এখতিয়ারসম্পন্ন, ক্ষমতাসম্পন্ন একটি প্রতিষ্ঠানে রূপ দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।”
নতুন অধ্যাদেশে কমিশনের কাঠামো, এখতিয়ার ও নিয়োগ প্রক্রিয়ায় বড় ধরনের সংস্কার আনা হয়েছে। কমিশনে থাকবেন একজন চেয়ারম্যান ও চারজন সার্বক্ষণিক সদস্য।
নিয়োগে স্বচ্ছতা ও যোগ্যতা নিশ্চিত করতে আপিল বিভাগের একজন বিচারকের নেতৃত্বে সাত সদস্যের একটি বাছাই কমিটি গঠনের বিধান রাখা হয়েছে। এই কমিটি গণবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে আবেদন আহ্বান করবে এবং সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে উপযুক্ত প্রার্থীদের সুপারিশ করবে।
ড. আসিফ নজরুল বলেন,
“আমরা নিয়োগ পদ্ধতিটা এমনভাবে করেছি যাতে অভিজ্ঞ, যোগ্য ও মানবাধিকার রক্ষায় সক্রিয় মানুষরা কমিশনে জায়গা পান। এটি রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত থাকবে।”
আন্তর্জাতিক মানে কাজ করবে কমিশন
নতুন অধ্যাদেশে কমিশনের এখতিয়ার শুধু সংবিধানসিদ্ধ মৌলিক অধিকারে সীমাবদ্ধ নয়। বাংলাদেশের অনুসমর্থিত আন্তর্জাতিক মানবাধিকার চুক্তি ও প্রথাগত আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃত অধিকারের সুরক্ষাও কমিশনের দায়িত্বের মধ্যে আনা হয়েছে।
আইন উপদেষ্টা বলেন,
“আমাদের সংবিধানের মৌলিক অধিকারের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদণ্ডও এখন কমিশনের এখতিয়ারে যুক্ত হয়েছে। ফলে কমিশন আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী কাজ করতে পারবে।”
শৃঙ্খলা বাহিনী ও সরকারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তের ক্ষমতা
নতুন অধ্যাদেশের অন্যতম বড় পরিবর্তন হলো এখতিয়ার সম্প্রসারণ। এখন থেকে মানবাধিকার কমিশন শৃঙ্খলা বাহিনীসহ রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সংঘটিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাতেও স্বাধীনভাবে তদন্ত করতে পারবে।
আগে কমিশনের এখতিয়ার সীমিত ছিল, বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তে বাধা ছিল। এখন সেই সীমাবদ্ধতা তুলে দেওয়া হয়েছে।
আইন উপদেষ্টা বলেন,
“মানবাধিকার কমিশনের কাজ শুধু প্রতীকী নয়, বাস্তব প্রতিকার নিশ্চিত করাও এর দায়িত্ব হবে।”
গুম প্রতিরোধ ও প্রতিকারেও ভূমিকা রাখবে কমিশন
অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, গুম প্রতিরোধ, প্রতিকার ও ভুক্তভোগী সুরক্ষা আইনসহ মানবাধিকার সংরক্ষণমূলক যেকোনো আইনের বাস্তবায়নের দায়িত্ব মানবাধিকার কমিশনের ওপর ন্যস্ত থাকবে।
এতে আলাদা করে ‘গুম কমিশন’ গঠনের প্রয়োজন হবে না।
ড. নজরুল বলেন,
“গুম-অপহরণসহ গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে কমিশন সরাসরি তদন্ত ও প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নিতে পারবে। এতে ভুক্তভোগী ও পরিবারগুলো ন্যায়বিচারের আওতায় আসবে।”
কমিশনের আদেশ মানা হবে বাধ্যতামূলক
নতুন অধ্যাদেশে কমিশনের আদেশ বা সুপারিশকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে—যা আগে ছিল না। এখন থেকে কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি কমিশনের নির্দেশ উপেক্ষা করলে তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।
আইন উপদেষ্টা বলেন,
“কমিশনের নির্দেশ আর শুধু পরামর্শ নয়, তা এখন আইনি বাধ্যবাধকতায় রূপ পেয়েছে। এতে প্রতিষ্ঠানটির কর্তৃত্ব ও মর্যাদা বহুগুণে বৃদ্ধি পাবে।”
একটি স্বাধীন ও জবাবদিহিমূলক প্রতিষ্ঠান গড়ার অঙ্গীকার
ব্রিফিংয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম ও উপ–প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ মজুমদার উপস্থিত ছিলেন।
উপদেষ্টা পরিষদের একাধিক সদস্য জানিয়েছেন, নতুন এই আইন মানবাধিকার কমিশনকে প্রকৃত অর্থে স্বাধীন, জবাবদিহিমূলক এবং জনগণের আস্থাভাজন প্রতিষ্ঠানে পরিণত করবে।
মানবাধিকার রক্ষায় দীর্ঘদিনের সমালোচনার মুখে থাকা কমিশনের জন্য এটি এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে। আইনি কাঠামো, নিয়োগে স্বচ্ছতা ও তদন্তের ক্ষমতা বৃদ্ধি—সব মিলিয়ে কমিশনের পুনর্জন্মের আশা করছে মানবাধিকার সংশ্লিষ্ট মহল।











সত্যের সন্ধানে আমরা — NRD News Media Limited