কোনো মামলায় পলাতক আসামি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন না—এমন বিধান সংযোজনের মাধ্যমে নির্বাচনসংক্রান্ত মূল আইন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধন, ২০২৫–এর খসড়া নীতিগত ও চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ।
আজ বৃহস্পতিবার প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে তাঁর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে এই খসড়া অনুমোদন করা হয়। বৈঠকে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টারাও উপস্থিত ছিলেন।
‘পলাতক আসামিরা নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না’
বৈঠক শেষে রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এক যৌথ ব্রিফিংয়ে সিদ্ধান্তের বিষয়টি জানান আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল এবং প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম।
আইন উপদেষ্টা বলেন, “বিভিন্ন মামলায় পলাতক ব্যক্তিরা যাতে নির্বাচন করতে না পারেন, সেই বিষয়ে নতুন করে বিধান সংযোজন করা হয়েছে। আদালত যখন কাউকে পলাতক ঘোষণা করবেন, তখন সেই ব্যক্তি নির্বাচনে অংশগ্রহণের যোগ্য থাকবেন না।”
তিনি আরও ব্যাখ্যা করেন, “পলাতক হওয়ার প্রক্রিয়া নির্ধারিত আইনি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই হয়। আদালত যখন কাউকে হাজির হতে বলেন, বিজ্ঞপ্তি জারি হয়, তবুও তিনি অনুপস্থিত থাকেন, তখন আদালত তাঁকে পলাতক ঘোষণা করেন। বিচার চলাকালে এমন হলে তিনি স্বয়ংক্রিয়ভাবে পলাতক হিসেবে গণ্য হবেন।”
নির্বাচনে শুদ্ধতা ও জবাবদিহি নিশ্চিতের পদক্ষেপ
সরকারি সূত্রে জানা গেছে, নির্বাচন কমিশনের প্রস্তাব ও আইন মন্ত্রণালয়ের খসড়া পর্যালোচনার পর এই সংশোধনীর অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। উদ্দেশ্য হলো, নির্বাচনে এমন ব্যক্তিদের অংশগ্রহণ রোধ করা, যারা আইনের শাসন এড়িয়ে চলছেন বা বিচার থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।
একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, “এই সংশোধনের মাধ্যমে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় নৈতিক মানদণ্ড আরও স্পষ্ট করা হলো। আইন লঙ্ঘনকারী বা আদালতের প্রতি অসম্মান প্রদর্শনকারী কোনো প্রার্থী এখন আর ভোটে দাঁড়াতে পারবেন না।”
পূর্ববর্তী সংশোধনীর ধারাবাহিকতা
এর আগে চলতি মাসের শুরুতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনেও গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনী আনা হয়। সেই সংশোধন অনুযায়ী, মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় যাঁদের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) গঠিত হয়েছে, তাঁরা জাতীয় সংসদ ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন না।
নতুন আরপিও সংশোধনী সেই ধারাবাহিকতাতেই আরেক ধাপ এগিয়ে গেল বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের মতে, এটি একদিকে যেমন গণতন্ত্রের সুশাসন নিশ্চিত করবে, অন্যদিকে জনগণের ভোটাধিকার ব্যবহারের ক্ষেত্রেও নৈতিক মানদণ্ড বজায় রাখবে।
প্রধান উপদেষ্টার দৃষ্টিভঙ্গি
বৈঠকে সভাপতির বক্তব্যে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, “নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা ও ন্যায়বিচারের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা এখন সবচেয়ে জরুরি। যারা আদালতের আদেশ অমান্য করেন, তাঁদের নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ দেওয়া ন্যায়বিচারের পরিপন্থী।”
তিনি আরও বলেন, “আমরা চাই আগামী জাতীয় নির্বাচন এমন এক মানদণ্ড তৈরি করুক, যা ভবিষ্যতের সব নির্বাচনের জন্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।”
নির্বাচনী নৈতিকতার নতুন অধ্যায়
আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সংশোধনী বাংলাদেশের নির্বাচনী ব্যবস্থায় নৈতিক জবাবদিহির নতুন ধারা তৈরি করবে। পলাতক আসামিদের প্রার্থীতা বাতিলের মাধ্যমে নির্বাচনী প্রক্রিয়া হবে আরও স্বচ্ছ ও সুশৃঙ্খল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপক বলেন, “এটি রাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় স্বচ্ছতা বাড়াবে এবং জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনবে। তবে আইনটির প্রয়োগে যেন রাজনৈতিক পক্ষপাত বা হয়রানি না হয়, সে দিকেও সতর্ক থাকতে হবে।”
আইন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, খসড়াটি এখন আইন কমিশনে পাঠানো হবে পর্যালোচনার জন্য। এরপর গেজেট প্রকাশের মাধ্যমে এটি কার্যকর করা হবে। সংশোধনী কার্যকর হলে পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার যোগ্যতার শর্তাবলিতে এই নতুন বিধান যুক্ত হবে।











সত্যের সন্ধানে আমরা — NRD News Media Limited