আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ আওয়ামী লীগের শাসনামলে সংঘটিত গুম ও নির্যাতনের অভিযোগে দায়ের হওয়া দুটি মামলা এবং রামপুরায় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের আরেক মামলায় ১৫ সেনা কর্মকর্তাকে গ্রেফতার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন। বুধবার সকালে ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বেঞ্চ এই নির্দেশ দেন।
ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারপতি মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।
একইসঙ্গে আদালত তিন মামলার পলাতক আসামীদের ট্রাইব্যুনালে হাজির হওয়ার আহ্বান জানিয়ে একটি বাংলা ও একটি ইংরেজি দৈনিকে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশেরও নির্দেশ দেন।
গুম ও নির্যাতনের মামলার প্রেক্ষাপট
গুমের দুটি মামলার একটি টিএফআই (টাস্ক ফোর্স ইন্টারোগেশন) সেলে নির্যাতন এবং অপরটি জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেলে (জেআইসি) সংঘটিত নির্যাতন সংক্রান্ত। অভিযোগপত্রে বলা হয়, এই সেলগুলোতে বিভিন্ন সময়ে বিরোধী রাজনৈতিক মতাদর্শের ব্যক্তিদের ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালানো হয়।
প্রসিকিউশন সূত্রে জানা যায়, এসব ঘটনায় রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সদস্যসহ উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে প্রাথমিক তদন্তে উঠে এসেছে।
ট্রাইব্যুনালে কঠোর নিরাপত্তা
বুধবার সকাল ৭টা ১৫ মিনিটে সাধারণ পোশাকে থাকা ১৫ সেনা কর্মকর্তাকে বাংলাদেশ জেলের বিশেষ প্রিজন ভ্যানে করে ট্রাইব্যুনালে আনা হয়। ট্রাইব্যুনাল চত্বর ও আশপাশের এলাকায় তখন ছিল কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা।
ট্রাইব্যুনাল প্রাঙ্গণ ঘিরে ছিল পুলিশ, র্যাব ও গোয়েন্দা সংস্থার যৌথ নিরাপত্তা বলয়।
প্রসিকিউশনের পক্ষে শুনানিতে অংশ নেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। আসামিপক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করেন ব্যারিস্টার এম সারোয়ার হোসেন।
আওয়ামী লীগ আমলের অভিযোগ ও গ্রেফতারি পরোয়ানা
এর আগে গত ৮ অক্টোবর ট্রাইব্যুনাল আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে সংঘটিত গুম ও নির্যাতনের ঘটনায় দায়ের হওয়া দুই মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তাঁর নিরাপত্তা উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল তারিক আহমেদ সিদ্দিকী এবং সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআইয়ের সাবেক পাঁচ মহাপরিচালকসহ ৩০ জনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে।
একই দিনে রামপুরা এলাকায় জুলাই–আগস্ট মাসে সংঘটিত ২৮ জনকে হত্যার ঘটনায় দায়ের করা মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় বিজিবি কর্মকর্তা রেদোয়ানুল ইসলাম ও মো. রাফাত বিন আলম মুনসহ চারজনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগও গ্রহণ করা হয়।
এই তিন মামলায় পরোয়ানাভুক্ত আসামীদের ২২ অক্টোবরের মধ্যে ট্রাইব্যুনালে হাজিরের নির্দেশও দেওয়া হয়েছিল।
সেনাবাহিনীর সহযোগিতা ও সাবজেলে স্থানান্তর
গ্রেফতারি পরোয়ানার পর সেনাবাহিনী ১৫ জন কর্মরত কর্মকর্তাকে হেফাজতে নেওয়ার কথা জানায়। গত ১১ অক্টোবর সেনাবাহিনীর অ্যাডজুট্যান্ট জেনারেল মেজর জেনারেল মো. হাকিমুজ্জামান এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “দুটি মামলার ৩০ আসামির মধ্যে ২৫ জনই সেনাবাহিনীর বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা। এর মধ্যে ৯ জন অবসরপ্রাপ্ত, একজন এলপিআরে, এবং কর্মরত আছেন ১৫ জন।”
আসামিপক্ষের আইনজীবী ব্যারিস্টার এম সারোয়ার হোসেন সাংবাদিকদের জানান, “স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঘোষিত সেনানিবাসের সাবজেলে তাঁদের রাখা হবে।”
প্রসিকিউশন পক্ষের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, “গ্রেফতার ও বিচারে সেনাবাহিনী সম্পূর্ণ সহযোগিতা করেছে। বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষাকারী বাহিনী হিসেবেও তারা ট্রাইব্যুনালের বিচারিক প্রক্রিয়াকে সম্মান দেখিয়েছে।”
পরবর্তী তারিখ ও বিচার প্রক্রিয়ার অগ্রগতি
ট্রাইব্যুনাল গুম সংক্রান্ত দুটি মামলার পরবর্তী শুনানির তারিখ ২০ নভেম্বর এবং রামপুরার মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলার শুনানির তারিখ ৫ নভেম্বর নির্ধারণ করেছে।
প্রসিকিউশন বলছে, এসব মামলায় প্রমাণ ও সাক্ষ্য উপস্থাপনের প্রস্তুতি প্রায় শেষ পর্যায়ে।
দেশে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার প্রক্রিয়া শুরুর পর এই প্রথম একসঙ্গে এত সংখ্যক কর্মরত সেনা কর্মকর্তাকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হলো। আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি দেশের বিচার ব্যবস্থার ইতিহাসে একটি তাৎপর্যপূর্ণ অধ্যায় তৈরি করবে।
বিচার পর্যবেক্ষকরা বলছেন, এই মামলাগুলোর রায় ভবিষ্যতে রাষ্ট্রীয় সংস্থা ও সামরিক প্রশাসনের জবাবদিহিতার নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে।
