২০১৩ সালের শাপলা চত্বরের ঘটনার শহীদ পরিবার এবং ২০২১ সালের মার্চ মাসের বিক্ষোভে নিহত শহীদ পরিবারদের জন্য ৭ কোটি ৭০ লাখ টাকার আর্থিক সহায়তা প্রদান করেছে স্থানীয় সরকার বিভাগ। শনিবার রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে এক বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানে ৭৭টি শহীদ পরিবারের হাতে প্রতিটি পরিবারের জন্য ১০ লাখ টাকা করে চেক হস্তান্তর করা হয়।
স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। বিশেষ অতিথি ছিলেন ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ডা. আ ফ ম খালিদ হোসেন। অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করেন স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব মো. রেজাউল মাকছুদ জাহেদী।
দুই ঐতিহাসিক আন্দোলনের শহীদদের প্রতি রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি
২০১৩ সালের ৫ মে রাজধানীর শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসমাবেশ ঘিরে সংঘটিত সহিংসতায় নিহত ৫৮টি পরিবার এবং ২০২১ সালের মার্চ মাসে মোদি-বিরোধী বিক্ষোভে নিহত ১৯টি পরিবারের সদস্যদের এই সহায়তা দেওয়া হয়।
এই দুটি ঘটনাকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ মোড় হিসেবে উল্লেখ করে স্থানীয় সরকার বিভাগ জানায়, শহীদ পরিবারের প্রতি এই আর্থিক সহায়তা কেবল অর্থ নয়, বরং তাদের আত্মত্যাগের স্বীকৃতি এবং স্মৃতি সংরক্ষণের একটি প্রতীকী পদক্ষেপ।
“শহীদদের রক্ত বৃথা যায় না”— স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা
প্রধান অতিথির বক্তব্যে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেন,
“শহীদদের রক্ত কখনো বৃথা যায় না। ঐতিহাসিক শাপলা চত্বরের শহীদদের আজকের এই স্বীকৃতি সেই রক্তের মর্যাদাকে প্রতিষ্ঠিত করছে। রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এই সহায়তা শুধু অর্থ নয়, এটি ইতিহাসের কাছে দায়মোচন।”
তিনি আরও জানান, শাপলা চত্বরে স্থায়ীভাবে ‘শহীদ স্মৃতি ফলক’ স্থাপন করা হবে, যেখানে ২০১৩ সালের ৫ মে’র নিহতদের নাম খোদাই করে সংরক্ষণ করা হবে।
“ইতিহাস থেকে যেন কেউ এই শহীদদের নাম মুছে দিতে না পারে, সেটিই আমাদের অঙ্গীকার,”— বলেন তিনি।
ধর্ম বিষয়ক উপদেষ্টা: “একটি ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার সূচনা”
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ডা. আ ফ ম খালিদ হোসেন বলেন,
“শাপলা চত্বর ও ২০২১ সালের আন্দোলনের শহীদদের আর্থিক সহায়তা প্রদান স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদের একটি ঐতিহাসিক উদ্যোগ। এর মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র প্রথমবারের মতো এই দুই ঘটনার শহীদদের প্রতি আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি প্রদান করল।”
তিনি বলেন, এই সহায়তা কেবল পরিবারগুলোর আর্থিক সুরক্ষা নয়, বরং শহীদদের আত্মত্যাগের প্রতি জাতির কৃতজ্ঞতার বহিঃপ্রকাশ।
শহীদ পরিবারগুলোর কৃতজ্ঞতা ও আবেগঘন মুহূর্ত
অনুষ্ঠানে উপস্থিত শহীদ পরিবারদের অনেকেই আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। কারও কারও চোখে ছিল অশ্রু, কেউবা সন্তানের ছবি হাতে দাঁড়িয়ে ছিলেন সম্মানিত অতিথিদের সামনে।
শাপলা চত্বরের শহীদ পরিবারের একজন প্রতিনিধি বলেন,
“দীর্ঘ বছর পর আমরা মনে করছি, রাষ্ট্র আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। এই স্বীকৃতি আমাদের পরিবারের জন্য অমূল্য।”
আলেম সমাজ ও রাজনৈতিক নেতাদের প্রতিক্রিয়া
অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে বক্তব্য দেন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমির মাওলানা শাহ মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী, যিনি বলেন,
“স্থানীয় সরকার উপদেষ্টার এই মহতী উদ্যোগে সারা বাংলার আলেম সমাজ সম্মানিত হয়েছে। শহীদ পরিবারের এই সহায়তা জাতির জন্য একটি দৃষ্টান্ত।”
তিনি সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেন,
“যে শহীদদের রক্তে ইতিহাস লেখা হয়েছে, তাদের মর্যাদা রক্ষা করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। আজ সেই দায়িত্ব পালন শুরু হলো।”
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার, এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান ভূঁইয়া মঞ্জু, খেলাফত মজলিসের মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হক, গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর, হেফাজতে ইসলামের সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা সাজিদুর রহমান এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রশাসক মো. শাহজাহান মিয়া।
সম্মান ও স্বীকৃতির নতুন অধ্যায়
স্থানীয় সরকার বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, শহীদ পরিবারগুলোকে এককালীন সহায়তা প্রদানের পাশাপাশি তাদের সন্তানদের জন্য শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের সুযোগও বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে।
অনুষ্ঠান শেষে স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা সাংবাদিকদের বলেন,
“এই সহায়তা একটি সূচনা মাত্র। আমরা চাই, শহীদদের আত্মত্যাগ ইতিহাসে অমলিন থাকুক। তাদের পরিবার যেন রাষ্ট্রের মর্যাদাপূর্ণ নাগরিক হিসেবে বেঁচে থাকতে পারে।”
