ফেনী জেলার পরশুরাম উপজেলার চারিগ্রাম ইউনিয়নের ছোট্ট বাজার ‘খন্ডল হাই’—সেখান থেকেই ছড়িয়ে পড়েছে এক মিষ্টিময় ঐতিহ্যের গল্প। প্রায় পাঁচ দশক আগে এক ভাগ্যান্বেষী মানুষ, যোগল চন্দ্র দাস, প্রথম তৈরি করেন এক অনন্য স্বাদের মিষ্টি, যা আজ ফেনীর গর্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে। নাম তার ‘খন্ডলের মিষ্টি’—যা এখন দেশের ৬১তম ভৌগোলিক নির্দেশক (GI) পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার অপেক্ষায়।
একটি ছোট বাজার থেকে জাতীয় গৌরবের পথে
জেলা শহর থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরের ছোট্ট গ্রামীণ বাজার ‘খন্ডল’। স্বাধীনতার বছর ১৯৭১ সালেই এখানে জন্ম নেয় এই মিষ্টির ঐতিহ্য। স্থানীয়রা জানান, বাজারের নামেই নামকরণ হয়েছিল মিষ্টিটির—‘খন্ডলের মিষ্টি’। রসগোল্লার মতো দেখতে হলেও স্বাদে, গন্ধে এবং তৈরির কৌশলে এটি সম্পূর্ণ আলাদা।
ফেনীর মানুষের কাছে “খন্ডল” মানেই এক স্বাদ-গর্বের নাম, যা এখন ফেনীর সীমানা ছাড়িয়ে দেশ-বিদেশেও পরিচিতি পাচ্ছে।
প্রথম উদ্ভাবক যোগল চন্দ্র দাসের গল্প
সত্তরের দশকের শেষ দিকে জীবিকার সন্ধানে বাড়ি ছেড়ে পরশুরামের খন্ডল হাই বাজারের পাশে বসতি গড়েন যোগল চন্দ্র দাস। শুরুতে চায়ের দোকান চালাতেন, সঙ্গে বানাতেন কয়েক প্রকার মিষ্টি। ধীরে ধীরে তার হাতে তৈরি স্পঞ্জের মিষ্টি আশপাশের এলাকায় সুনাম পেতে শুরু করে।
তিনি একসময় অসুস্থ হয়ে ব্যবসা ছেড়ে দিলেও তার শিষ্যরা—বিশেষত কবির আহম্মদ পাটোয়ারী—এই ঐতিহ্য ধরে রাখেন। কবির আহম্মদের হাত ধরেই খন্ডলের মিষ্টি নাম পায়, খ্যাতি পায়, আর আজ তা জিআই স্বীকৃতির দোরগোড়ায়। বর্তমানে কবির আহম্মদের সন্তানরা মিষ্টির দোকান পরিচালনা করছেন।
জিআই স্বীকৃতির পথে আনুষ্ঠানিক আবেদন
পরশুরাম উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, ‘খন্ডলের পাটোয়ারী মিষ্টি মেলা’র স্বত্বাধিকারী মো. বেলাল হোসেন পাটোয়ারী খন্ডলের মিষ্টিকে জিআই পণ্য হিসেবে নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছেন।
তার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ১৭ আগস্ট ২০২৫ তারিখে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফাহরিয়া ইসলাম স্বাক্ষরিত এক পত্রে খন্ডলের মিষ্টিকে জিআই স্বীকৃতি প্রদানের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ জানানো হয়েছে।
যদি অনুমোদন মেলে, তবে এটি হবে বাংলাদেশের ৬১তম জিআই পণ্য—এর আগে সর্বশেষ ২০২৪ সালের ১ আগস্ট ফরিদপুরের পাট পেয়েছিল এই স্বীকৃতি।
তৈরির ধাপে ধাপে ঐতিহ্য
খন্ডলের মিষ্টির প্রস্তুতি প্রক্রিয়াও বিশেষ ও যত্নসাধ্য। স্থানীয় কারিগরদের মতে—
- আশপাশের গ্রাম থেকে তাজা দুধ এনে সুতি কাপড়ে ছেঁকে নেওয়া হয়।
- এরপর ১৭ কেজি দুধে টক পানি ও ঠান্ডা পানি মিশিয়ে তৈরি হয় ২ কেজি ছানা।
- ছানায় মেশানো হয় ২০ গ্রামের মতো ময়দা, যা মিষ্টিকে ফোলাভাব দেয়।
- অন্যদিকে ৬ লিটার পানিতে ৫ কেজি চিনি জ্বাল দিয়ে তৈরি হয় রস।
- এরপর আধঘণ্টা জ্বাল দিয়ে ছানার মণ্ড রসে ছেড়ে তৈরি হয় বিখ্যাত খন্ডলের মিষ্টি।
এই মিষ্টির অন্যতম বৈশিষ্ট্য—এটি গরম ও ঠান্ডা দুইভাবেই সমান সুস্বাদু।
দুটি দোকানেই মেলে আসল খন্ডলের মিষ্টি
ফেনীজুড়ে ‘খন্ডলের মিষ্টি’ নামে অনেক দোকান থাকলেও, স্থানীয়দের দাবি—মাত্র দুটি দোকানেই পাওয়া যায় আসল মিষ্টি।
খন্ডলের পাটোয়ারী মিষ্টি মেলা — বেলাল হোসেন পাটোয়ারী
খন্ডলের আসল মিষ্টি মেলা — দেলোয়ার হোসেন
বেলাল পাটোয়ারী বলেন, “আমার বাবা কবির আহম্মদ পাটোয়ারী ১৯৭১ সালে এই প্রতিষ্ঠানের যাত্রা শুরু করেন। এখন আমরা তাঁর সেই ঐতিহ্য ধরে রাখছি। দিনে গড়ে ১৫০ কেজি মিষ্টি তৈরি হয়। চাহিদা বেশি হলেও আমরা গুণমানে ছাড় দিই না।”
মূল্য ও জনপ্রিয়তা
- রসসহ প্রতি কেজি মিষ্টির দাম ১৬০ টাকা
- রসরহিত সংস্করণ ২৬০ টাকা প্রতি কেজি
ফেনী, চট্টগ্রাম, ঢাকা ছাড়াও এই মিষ্টি এখন প্রবাসী ফেনীবাসীদের কাছেও নিয়মিত পাঠানো হয়।
স্থানীয়দের গর্ব ও প্রত্যাশা
ফেনীবাসীর প্রত্যাশা—জিআই স্বীকৃতি পেলে ‘খন্ডলের মিষ্টি’ শুধু ফেনীর নয়, বাংলাদেশেরও এক ঐতিহ্যবাহী ব্র্যান্ডে পরিণত হবে।
স্থানীয় সাংবাদিক এম এ হাসান বলেন, “এই মিষ্টি শুধু খাবার নয়, এটি ফেনীর ইতিহাস, পরিশ্রম ও সৃজনশীলতার প্রতীক। যোগল দাসের হাতের সেই মিষ্টি আজও ফেনীর সংস্কৃতিকে মিষ্টিময় করে রেখেছে।”
যেখানে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী পণ্য জিআই সনদ পাচ্ছে, সেখানে ফেনীর ‘খন্ডলের মিষ্টি’ও সময়ের অপেক্ষায়।
অল্প কয়েকজন কারিগরের হাতে তৈরি এই মিষ্টি কেবল ফেনীর নয়—বাংলার মিষ্টান্ন ঐতিহ্যের গর্বিত প্রতিনিধি।
স্বীকৃতির পর এটি হয়তো বাংলাদেশের ‘মিষ্টি মানচিত্রে’ নতুন এক উজ্জ্বল নাম হয়ে উঠবে—খন্ডলের মিষ্টি।
