রাজধানীর মিরপুরের রূপনগরে শাহ আলম কেমিক্যাল গোডাউন সংলগ্ন প্রিন্টিং কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ১৬ জনের প্রাণহানির ঘটনায় সরকার সাত সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। দুর্ঘটনার কারণ, দায়দায়িত্ব ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণের পাশাপাশি ভবিষ্যতে এমন দুর্ঘটনা প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের সুপারিশ করাই কমিটির প্রধান দায়িত্ব।
এই তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব লস্কার তাজুল ইসলামকে। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী, কমিটিকে আগামী সাত কর্মদিবসের মধ্যে একটি পূর্ণাঙ্গ ও বস্তুনিষ্ঠ প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
দুঃসহ অগ্নিকাণ্ডে ১৬ প্রাণহানি
গত মঙ্গলবার (১৪ অক্টোবর) রাতে মিরপুরের রূপনগরে শাহ আলম কেমিক্যাল গোডাউনের পাশে অবস্থিত একটি প্রিন্টিং কারখানায় আকস্মিকভাবে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটে। মুহূর্তের মধ্যে আগুন ছড়িয়ে পড়ে চারদিক জুড়ে। ফায়ার সার্ভিসের অন্তত ১২টি ইউনিট প্রায় তিন ঘণ্টার প্রচেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।
এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত ১৬ জনের মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়েছে। দগ্ধ ও আহত অবস্থায় আরও বেশ কয়েকজনকে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়েছে।
ফায়ার সার্ভিসের প্রাথমিক ধারণা, রাসায়নিক দ্রব্যের উপস্থিতি ও পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা না থাকায় আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।
প্রধান উপদেষ্টা ও উপদেষ্টাদের শোক
অগ্নিকাণ্ডে হতাহতের ঘটনায় গভীর শোক প্রকাশ করেছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস এবং সরকারের বিভিন্ন উপদেষ্টা। শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন এক বিবৃতিতে নিহতদের আত্মার মাগফিরাত ও আহতদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করেছেন।
তিনি বলেন,
“এ ধরনের দুর্ঘটনা আর যেন না ঘটে, সে জন্য সরকারের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ নেওয়া হবে। কর্মস্থলে শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি।”
নিহত পরিবারের জন্য আর্থিক সহায়তা
দুর্ঘটনায় নিহত শ্রমিকদের পরিবারকে বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে প্রতি পরিবারে দুই লাখ টাকা করে আর্থিক সহায়তা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে শ্রম মন্ত্রণালয়। পাশাপাশি আহত শ্রমিকদের চিকিৎসা সহায়তা হিসেবে ৫০ হাজার টাকা করে অনুদান প্রদান করা হবে।
মন্ত্রণালয়ের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, এই সহায়তা দ্রুত ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর কাছে পৌঁছে দিতে ইতোমধ্যে ফাউন্ডেশনকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
তদন্ত কমিটির দায়িত্ব ও লক্ষ্য
গঠিত তদন্ত কমিটি অগ্নিকাণ্ডের কারণ অনুসন্ধান ছাড়াও নিম্নলিখিত বিষয়গুলো যাচাই করবে—
- কারখানার নিরাপত্তা ব্যবস্থায় কোনো গাফিলতি ছিল কি না।
- সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ও তদারকির ঘাটতি চিহ্নিত করা।
- ক্ষয়ক্ষতির বিস্তারিত হিসাব প্রস্তুত করা।
- শ্রমিকদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করতে প্রয়োজনীয় সুপারিশ প্রদান।
- দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে শনাক্ত করে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের প্রস্তাব করা।
কমিটি সংশ্লিষ্ট কারখানা ও আশপাশের এলাকার ঝুঁকি মূল্যায়নও করবে এবং ভবিষ্যতে শিল্পকারখানায় অগ্নিনিরাপত্তা নিশ্চিতে দীর্ঘমেয়াদি নীতিগত প্রস্তাবনা জমা দেবে।
শিল্পাঞ্চলে নিরাপত্তাহীনতার শঙ্কা
রাজধানী ও আশপাশের শিল্পাঞ্চলগুলোতে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে একের পর এক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। শ্রম অধিকার সংগঠনগুলো বলছে, বেশিরভাগ ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পপ্রতিষ্ঠানে অগ্নিনিরাপত্তা সরঞ্জাম নেই, কিংবা থাকলেও তা কার্যকর অবস্থায় থাকে না।
শ্রম অধিকারকর্মী রুবিনা ইয়াসমিন বলেন,
“রূপনগরের এই দুর্ঘটনা প্রমাণ করে, এখনো অনেক কারখানা ন্যূনতম নিরাপত্তা মান বজায় রাখে না। তদন্ত কমিটি যেন শুধুমাত্র কাগুজে সুপারিশে সীমাবদ্ধ না থাকে, সেটিই এখন সবচেয়ে জরুরি।”
ভবিষ্যৎ পদক্ষেপের আশ্বাস
শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টা ড. সাখাওয়াত হোসেন জানিয়েছেন, মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যেই শিল্প কারখানায় নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য নতুন নির্দেশনা প্রস্তুত করছে। তিনি বলেন,
“আমরা চাই, প্রতিটি শ্রমিক নিরাপদে কাজ করুক। এই দুর্ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতে আরও কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
মিরপুরের এই অগ্নিকাণ্ড আবারও স্মরণ করিয়ে দিল—শ্রমিকদের জীবন এখনো কতটা অনিরাপদ। সরকারের দ্রুত তদন্ত ও আর্থিক সহায়তার ঘোষণা ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের কিছুটা সান্ত্বনা দিতে পারে, কিন্তু নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত না হলে এমন মর্মান্তিক ঘটনা ভবিষ্যতেও ফিরে আসতে পারে।
