রাজধানীর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার আজ দিনভর পরিণত হয়েছে শিক্ষকদের এক মিলনমেলায়। সকাল থেকে ধীরে ধীরে বাড়তে থাকা উপস্থিতি দুপুর গড়াতেই রূপ নেয় জনসমুদ্রে। মূল দাবিগুলো—বাড়িভাড়া ভাতা, চিকিৎসা ভাতা ও উৎসব ভাতার বৃদ্ধিসহ তিন দফা বাস্তবায়নের দাবিতে এমপিওভুক্ত শিক্ষক ও কর্মচারীরা দ্বিতীয় দিনের মতো অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন সেখানে।
সরকারকে দেওয়া সময়সীমা আজ মঙ্গলবার বিকেল তিনটায় শেষ হয়েছে। নির্ধারিত সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরও যখন দাবি পূরণের কোনো নিশ্চয়তা আসেনি, তখনই শিক্ষকরা সিদ্ধান্ত নেন সচিবালয় অভিমুখে লংমার্চ শুরু করবেন। বিকেল চারটার দিকে লংমার্চ শুরুর প্রস্তুতি প্রায় সম্পন্ন হয়। চারপাশে তখন এক ধরনের উত্তেজনা ও প্রতীক্ষার আবহ।
দাবির পেছনের প্রেক্ষাপট
বাংলাদেশের মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরের অসংখ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা দীর্ঘদিন ধরে ভাতা কাঠামোর বৈষম্য নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে আসছেন। তাঁদের দাবি—
১️⃣ মূল বেতনের ২০ শতাংশ বা ন্যূনতম তিন হাজার টাকা বাড়িভাড়া ভাতা হিসেবে প্রদান করতে হবে।
২️⃣ শিক্ষক ও কর্মচারী উভয়ের জন্য চিকিৎসা ভাতা দেড় হাজার টাকায় উন্নীত করতে হবে।
৩️⃣ কর্মচারীদের উৎসব ভাতা বর্তমানের ৫০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৭৫ শতাংশ করতে হবে।
শিক্ষকরা বলছেন, জীবনযাত্রার ব্যয় যেমন বাড়ছে, তাঁদের ভাতা কাঠামো তেমন সমন্বয় পাচ্ছে না। ফলে দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
একজন শিক্ষক বলেন, “আমরা দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গড়ি, কিন্তু নিজেদের ন্যায্য দাবি নিয়ে রাস্তায় নামতে বাধ্য হচ্ছি—এটাই কষ্টের।”
অবস্থান থেকে লংমার্চ—প্রস্তুতি ও আবেগ
আজ দুপুরে শহীদ মিনার ঘুরে দেখা যায়, চারদিক জুড়ে ব্যানার, পোস্টার ও স্লোগানে মুখর পরিবেশ। অনেকে মাথায় সাদা কাপড় বেঁধে একাত্মতার প্রতীক দেখাচ্ছেন। কেউ কেউ হাতে হাতে পোস্টার তুলে ধরেছেন—‘শিক্ষক বাঁচলে শিক্ষা বাঁচবে’, ‘ন্যায্য দাবি মানতেই হবে’।
বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আশপাশের এলাকা শিক্ষক ও কর্মচারীদের ঢলে আরও সরগরম হয়ে ওঠে। অনেকে জেলা পর্যায় থেকেও এসেছেন এই কর্মসূচিতে যোগ দিতে। তাঁদের অনেকেই জানালেন, দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত তারা রাজধানী ছাড়বেন না।
লংমার্চের জন্য অস্থায়ী চিকিৎসা সহায়তা কেন্দ্রও স্থাপন করা হয়েছে শহীদ মিনার চত্বরে। সংগঠনের নেতারা শিক্ষক-কর্মচারীদের শৃঙ্খলা বজায় রাখার আহ্বান জানাচ্ছেন। বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে কর্মসূচির নেতৃত্বে থাকা শিক্ষক নেতারা মঞ্চে উঠে ঘোষণা দেন—“আমরা শান্তিপূর্ণভাবে সচিবালয় অভিমুখে যাত্রা করব। সরকার যদি এখনই সাড়া না দেয়, তবে পরবর্তী কর্মসূচি আরও কঠোর হবে।”
সরকারি প্রতিক্রিয়া ও পরবর্তী পদক্ষেপ
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, শিক্ষক-কর্মচারীদের দাবিগুলো সরকার গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে। তবে বাড়িভাড়া ও অন্যান্য ভাতা কাঠামো পুনর্নির্ধারণে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন প্রয়োজন, যা কিছুটা সময়সাপেক্ষ।
অন্যদিকে আন্দোলনকারীরা বলছেন, “সময়সাপেক্ষ” কথাটি তারা অনেকবার শুনেছেন, কিন্তু বাস্তবায়ন হয় না। তাই এবার তাঁরা প্রতিশ্রুতি নয়, লিখিত নির্দেশনা চান।
শিক্ষক সমাজের বার্তা
বিশেষজ্ঞদের মতে, শিক্ষকদের এ ধরনের আন্দোলন শিক্ষা ব্যবস্থার গভীর অসাম্যকে সামনে নিয়ে আসে। শিক্ষকদের ন্যায্য প্রাপ্য নিশ্চিত না হলে মানসম্মত শিক্ষা অর্জন কঠিন হয়ে পড়ে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের এক অধ্যাপক বলেন, “যাঁরা শিক্ষাদানের মতো গুরুত্বপূর্ণ পেশায় আছেন, তাঁদের সামাজিক ও আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের নৈতিক দায়িত্ব। সরকারের উচিত দ্রুত আলোচনার মাধ্যমে এই সংকটের সমাধান করা।”
বিকেল গড়াতেই শহীদ মিনারের জনসমুদ্র ধীরে ধীরে সচিবালয় অভিমুখে স্লোগানের ঢেউ তোলে—“ন্যায্য দাবি, অবিলম্বে মেনে নাও।” রাজধানীর রাস্তায় শুরু হয় শিক্ষকদের লংমার্চ। কেউ হাতে জাতীয় পতাকা, কেউ হাতে বই—সবাইয়ের কণ্ঠে এক সুর, “শিক্ষক বাঁচলে, শিক্ষা বাঁচবে।”
