“চমচম” শব্দটি উচ্চারিত হলেই মনে ভেসে ওঠে এক টুকরো ইতিহাস, মাওয়ার আস্তরণে মোড়ানো রসালো এক মিষ্টির প্রতিচ্ছবি—টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির বিখ্যাত চমচম। দুই শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে রসনাবিলাসী বাঙালির তৃপ্তির প্রতীক এই মিষ্টান্ন, যা এখন পেয়েছে সরকারি স্বীকৃতি—ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে।
গত ২৫ এপ্রিল ২০২৪ টাঙ্গাইল জেলা প্রশাসকের আবেদনের ভিত্তিতে সরকার পোড়াবাড়ির চমচমকে জিআই পণ্য হিসেবে ঘোষণা দেয়। “টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ি চমচম”—এখন শুধু একটি মিষ্টির নাম নয়, এটি বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতীকও বটে।
চমচমের শিকড় পোড়াবাড়ির মাটিতে
টাঙ্গাইল শহর থেকে মাত্র ছয় কিলোমিটার পশ্চিমে ধলেশ্বরী নদীর তীরে ছোট্ট গ্রাম পোড়াবাড়ি। এখানেই চমচমের জন্ম। স্থানীয়ভাবে ধারণা করা হয়, ব্রিটিশ আমলে দশরথ গৌড় নামের এক মিষ্টি কারিগর আসাম থেকে এসে এই গ্রামে প্রথম চমচম তৈরি শুরু করেন। ধলেশ্বরীর মিঠা পানি, গরুর খাঁটি দুধ আর কাঠের জ্বালেই তৈরি হতো এই মিষ্টির অনন্য স্বাদ।
পরে তাঁর উত্তরসূরিরা—রাজা রামগৌড়, নারায়ণ গৌড়, মোহন লাল, প্রকাশ চন্দ্র দে সরকারসহ আরও অনেকে এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখেন। পাকিস্তান আমলে নারায়ণ গৌড় এই চমচমকে উপমহাদেশজুড়ে খ্যাতি এনে দেন। এমনকি মওলানা ভাসানী তাঁকে ‘বাঙালি হালুইকর’ উপাধি দিয়েছিলেন।
জমজমাট পোড়াবাড়ি থেকে ইতিহাসের গহীনে
একসময় পোড়াবাড়ি বাজারে ছিল শতাধিক মিষ্টির দোকান। ধলেশ্বরী নদী দিয়ে ঢাকা-কলকাতা যাওয়া লঞ্চ-স্টিমারের ভেঁপুর শব্দে মুখর থাকত পুরো এলাকা। বণিকরা টাঙ্গাইলের পাট কিনতে এসে পোড়াবাড়ির চমচম না কিনে ফিরতেন না।
কিন্তু কালের বিবর্তনে সেই ঐতিহ্য ম্লান। বর্তমানে পোড়াবাড়িতে টিকে আছে মাত্র চারটি মিষ্টির দোকান, আর আশপাশের গ্রাম মিলিয়ে ৮–১০টি পরিবার এখনও এই চমচম তৈরির কাজ করছেন।
চমচম তৈরির রহস্য
চমচম তৈরির মূল রহস্য—ধলেশ্বরীর পানির স্বাদ, খাঁটি দুধ, লালচিনি ও তেঁতুল কাঠের জ্বাল। ১৫ কেজি দুধ জ্বাল দিয়ে পাওয়া যায় আধা কেজি মাওয়া, যা দিয়ে তৈরি হয় এক কেজি চমচম।
শ্রীমন্টু চন্দ্র গৌড়, যিনি এখনো ঐতিহ্য রক্ষার চেষ্টা করছেন, জানান—“স্বাধীনতার পরেও প্রতিদিন দুই-তিন মণ চমচম বিক্রি করতাম। এখন দিনে ২০–২২ কেজি বিক্রি করতেও কষ্ট হয়। খরচ বেড়েছে, শ্রমের দাম নেই, তাই অনেকেই পেশা বদলেছেন।”
বর্তমানে অরিজিনাল পোড়াবাড়ির চমচম বিক্রি হয় ৪০০ টাকা কেজি, আর সাধারণ মানের চমচম পাওয়া যায় ২৫০ টাকায়।
টাঙ্গাইল শহরের মিষ্টি পট্টি
ত্রিশের দশকে রামেন্দ্র ঠাকুর ও তীর্থবাসী ঠাকুর পোড়াবাড়ি থেকে শহরে এসে ‘পাঁচআনী বাজারে’ মিষ্টির দোকান খোলেন। তখন থেকেই এই এলাকা পরিচিত হয় “মিষ্টি পট্টি” নামে। আজও সেখানে অর্ধশতাধিক দোকানে তৈরি হয় নানা রকম মিষ্টান্ন, তবে সবার ওপরে রয়েছে পোড়াবাড়ির চমচম।
বর্তমানে ঐতিহ্য ধরে রেখেছে জয় কালী মিষ্টান্ন ভান্ডার, গোপাল মিষ্টান্ন ভান্ডার ও গৌর ঘোষ মিষ্টান্ন ভান্ডার। জয় কালী মিষ্টান্ন ভান্ডারের স্বত্বাধিকারী স্বপন ঘোষ বলেন, “৮৫ বছর ধরে আমরা গুণগত মান অক্ষুণ্ণ রেখে কাজ করছি। দেশে-বিদেশে টাঙ্গাইলের চমচমের চাহিদা বাড়ছে।”
চমচমের রপ্তানি ও জনপ্রিয়তা
এখন পোড়াবাড়ির চমচম পৌঁছে যাচ্ছে ভারত, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড, চায়না, যুক্তরাজ্য, কানাডা, আমেরিকা, সৌদি আরব ও দুবাই পর্যন্ত। বাঙালি প্রবাসীদের কাছে এটি ঈদ, পূজা, বা যেকোনো উৎসবের অপরিহার্য অংশ।
ক্রেতা মানিক মিয়া ঢাকায় মিষ্টি কিনতে এসে বলেন,
“দেশের অনেক জায়গার মিষ্টি খেয়েছি, কিন্তু টাঙ্গাইলের চমচমের মতো স্বাদ অন্য কোথাও পাইনি।”
ঐতিহ্য রক্ষার আহ্বান
জেলা নাগরিক অধিকার সুরক্ষা কমিটির সভাপতি ও মুক্তিযোদ্ধা হামিদুল হক মোহন বলেন, “চমচম শুধু মিষ্টি নয়, এটি টাঙ্গাইলের পরিচয়ের অংশ। এখনো কয়েকজন কারিগর ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন—তাদের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া জরুরি।”
পোড়াবাড়ির প্রবীণ কারিগররা বলেন, “যদি তরুণ প্রজন্মকে প্রশিক্ষণ ও সহায়তা দেওয়া যায়, তাহলে পোড়াবাড়ির চমচম আবারও ফিরে পাবে তার পুরোনো গৌরব।”
শেষ কথা
দুই শতাব্দীর ঐতিহ্যবাহী এই মিষ্টান্ন এখন আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের এক গৌরবময় পরিচয়—জিআই পণ্য হিসেবে টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচম।
তবু সময়ের কাছে এর অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা আজ এক বড় চ্যালেঞ্জ।
যদি স্থানীয় উদ্যোগ, সরকারি সহায়তা ও নতুন প্রজন্মের আগ্রহ একসঙ্গে মিলে যায়—তবে হয়তো আবারও শোনা যাবে সেই পুরোনো প্রবাদ—
“চমচম, টমটম, শাড়ি—এই তিনে টাঙ্গাইলের বাড়ি।”
