সাহিত্য ও শিক্ষাক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য সুপরিচিত সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। শুক্রবার বিকেলে রাজধানীর ল্যাবএইড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৭৪ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুতে দেশের সাহিত্য, সংস্কৃতি ও শিক্ষাজগতে গভীর শোক নেমে এসেছে।
আজ শনিবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে মরদেহটি প্রথমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলা ভবনের সামনে নিয়ে আসা হয়, যেখানে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা ফুল দিয়ে তাঁকে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে মরদেহটি বেলা ১১টার পর পৌঁছে, যেখানে সর্বস্তরের মানুষ তাঁদের শ্রদ্ধার্ঘ্য জানিয়েছেন। অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন কলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক সিদ্দিকুর রহমান খান, ইংরেজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তাজিন আজিজ চৌধুরী, বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অ্যালামনাই সংগঠন।
জাতীয় কবিতা পরিষদ জানিয়েছে, শ্রদ্ধা নিবেদনের সুযোগ শেষে বাদ জোহর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদে জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। এরপর মরদেহ মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফন করা হবে।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের শারীরিক অবস্থার হঠাৎ অবনতি ঘটে ৩ অক্টোবর। ধানমন্ডিতে ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশে যাওয়ার পথে তিনি গাড়িতে অসুস্থ হয়ে পড়েন। প্রাথমিকভাবে স্থানীয় হাসপাতালে নেওয়া হয় এবং পরে ল্যাবএইড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসকরা জানান, তাঁর ‘ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক’ হয়। অস্ত্রোপচার করে দুটি রিং স্থাপন করা হলেও পরদিন অবস্থার আশঙ্কাজনক হওয়ায় তাকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়েছিল। ৪৮ ঘণ্টার মধ্য কিছুটা উন্নতি হলেও পুনরায় লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়।
জীবন ও শিক্ষা:
১৯৫১ সালের ১৮ জানুয়ারি সিলেটে জন্মগ্রহণ করেন সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি বিভাগে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। পরবর্তীতে কানাডার কুইন্স বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘ইয়েটসের কবিতায় ইমানুয়েল সুইডেনবার্গের দর্শনের প্রভাব’ বিষয়ে পিএইচডি অর্জন করেন।
পেশাগত জীবনে দীর্ঘদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন এবং সর্বশেষ ইমেরিটাস অধ্যাপক হিসেবে ছিলেন।
সাহিত্য ও অবদান:
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম ছিলেন দেশের অগ্রগণ্য সাহিত্যিক, অনুবাদক ও প্রাবন্ধিক। তাঁর ছোটগল্প ও উপন্যাসে অসাধারণ দক্ষতা তাঁকে বাংলা সাহিত্যে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে। ছোটগল্পকার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন ১৯৭৪ সালে ‘বিশাল মৃত্যু’ গল্পের মাধ্যমে। তাঁর অন্যান্য গল্পগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে—‘অন্ধকার ও আলো দেখার গল্প’, ‘প্রেম ও প্রার্থনার গল্প’, ‘সুখ ও দুঃখের গল্প’। আলোচিত উপন্যাসের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘আজগুবি রাত’ ও ‘তিন পর্বেও জীবন’।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের চিত্রকলা ও নন্দনতত্ত্ব সম্পর্কেও গুরুত্বপূর্ণ রচনা রয়েছে। সাহিত্যে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি ১৯৯৬ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার ও ২০১৮ সালে একুশে পদক লাভ করেন।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম স্ত্রী, এক পুত্রসহ বহু গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। তাঁর প্রয়াণে দেশের শিক্ষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির অঙ্গনে শূন্যতা তৈরি হয়েছে। দেশের শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক ও সংস্কৃতিকর্মীরা হাসপাতালে ছুটে এসে শেষ বিদায় জানান।
কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের প্রাঙ্গণে সাধারণ মানুষ, শিক্ষার্থী ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। শ্রদ্ধার্ঘ্য প্রদানের সময় ফুল ও মর্যাদাপূর্ণ শ্রদ্ধাঞ্জলি দিয়ে তাঁকে স্মরণ করা হয়েছে। এই অনুষ্ঠান দেশের মানুষের কাছে একটি গভীর শোক ও সম্মান প্রদর্শনের প্রতীক হিসেবে প্রতীয়মান হয়েছে।
