প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, “আমাদের কাছে এটা পরিষ্কার হতে হবে যে আমরা আর পরনির্ভর হতে চাই না। আমাদেরকে স্বনির্ভর হতে হবে।”
তিনি জোর দিয়ে বলেন, “এখন আমরা অনেক ক্ষেত্রেই পরনির্ভর হয়ে আছি। যত দ্রুত সম্ভব এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে হবে। এর বাইরে আর কোনো পথ নেই।”
বুধবার রাজধানীর তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত ‘জাতীয় স্টিয়ারিং কমিটির’ সভায় তিনি এসব কথা বলেন। এই কমিটি গঠিত হয়েছে স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে বাংলাদেশের মসৃণ ও টেকসই উত্তরণ কৌশল বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ করার জন্য।
সভায় প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “স্বনির্ভর বাংলাদেশ গঠনের জন্য আমাদের মনোভাব ও অভ্যাস বদলাতে হবে। আত্মনির্ভর হতে হলে বুদ্ধি খাটাতে হবে, পরিশ্রম করতে হবে, সংগ্রাম করতে হবে। এটি কঠিন হলেও এর মধ্যে আনন্দ আছে, মর্যাদা আছে। নতুন বাংলাদেশ মানেই হবে স্বনির্ভর বাংলাদেশ।”
‘নতুন বাংলাদেশ মানেই স্বনির্ভর বাংলাদেশ’
ড. ইউনূস বলেন, “এই জাতির যথেষ্ট সক্ষমতা আছে নিজ পায়ে দাঁড়ানোর। আমাদের সবচেয়ে বড় শক্তি হলো তারুণ্য ও সৃজনশীলতা। এ শক্তিকে কাজে লাগিয়ে আত্মনির্ভর অর্থনীতি গড়ে তুলতে হবে। জাতিকে অর্থনৈতিক দাসত্ব থেকে মুক্ত করতে হবে—আমরা আর কারও ওপর নির্ভর করে থাকতে চাই না।”
তিনি বলেন, “স্বনির্ভরতা মানে শুধু অর্থনীতিতে নয়, চিন্তা, নীতি, উদ্ভাবন এবং প্রযুক্তিতেও নিজের পথ নিজেকেই তৈরি করা। বিদেশি সাহায্যের ওপর নির্ভর না থেকে, নিজেদের সম্পদ, দক্ষতা ও উদ্ভাবনী শক্তিকেই মূল ভরসা করতে হবে।”
প্রধান উপদেষ্টা আরও যোগ করেন, “আমরা যদি নিজস্ব উদ্ভাবন, প্রযুক্তি এবং উদ্যোক্তা মনোভাবকে কাজে লাগাতে পারি, তাহলে কোনো বাধাই টেকসই উন্নয়নের পথে আমাদের থামাতে পারবে না।”
স্বনির্ভরতা অর্জনে ঐক্য ও অংশীদারিত্বের ওপর জোর
সভায় সরকারি উপদেষ্টাদের পাশাপাশি ব্যবসায়ী, অর্থনীতিবিদ ও বেসরকারি খাতের প্রতিনিধিরাও উপস্থিত ছিলেন। ড. ইউনূস তাঁদের উদ্দেশে বলেন, “স্বনির্ভরতা একটি যৌথ প্রয়াস। সরকার, ব্যবসায়ী, শিক্ষাবিদ, কৃষক—সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। এই সহযোগিতার মধ্য দিয়েই আমরা টেকসই উন্নয়নের দিকে এগিয়ে যাব।”
সভায় তিনি নির্দেশ দেন, জাতীয় উত্তরণ কৌশলের আওতায় প্রযুক্তি উদ্ভাবন, কৃষি উৎপাদন, রপ্তানি বৈচিত্র্য, মানবসম্পদ উন্নয়ন ও টেকসই অর্থনৈতিক নীতিমালা প্রণয়নে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
উপস্থিতি ও আলোচ্য বিষয়
সভায় উপস্থিত ছিলেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ, বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন, শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান, পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মোহাম্মদ তৌহিদ হোসেন, কৃষি উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম. সাখাওয়াত হোসেন, পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ড. আনিসুজ্জামান চৌধুরী, মুখ্য সচিব সিরাজ উদ্দিন মিয়া, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর, এবং এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান।
এছাড়া বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান, এফবিসিসিআই সভাপতি মাহবুবুল আলম, ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি তাসকীন আহমেদ, এবং বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি আব্দুল মুক্তাদির সভায় উপস্থিত ছিলেন।
সভা শেষে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এক ব্রিফিংয়ে বলেন, “প্রধান উপদেষ্টার মূল বার্তা হলো—দেশকে এখন নিজস্ব শক্তিতে দাঁড়াতে হবে। স্বনির্ভরতা শুধু অর্থনৈতিক নয়, এটি জাতীয় মানসিকতার বিষয়।”
‘আমরা নিজের পথ নিজেই তৈরি করব’
সভায় উপস্থিত উপদেষ্টারা এবং ব্যবসায়ী প্রতিনিধিরা প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করেন। তাঁরা বলেন, বাংলাদেশের উন্নয়ন যাত্রা এখন এমন এক মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছে, যেখানে আত্মনির্ভরতা ছাড়া স্থায়ী অগ্রগতি সম্ভব নয়।
প্রধান উপদেষ্টা ইউনূস শেষ বক্তব্যে বলেন, “আমরা নিজের পথ নিজেই তৈরি করব। অন্যের নির্দেশে নয়, নিজেদের মেধা ও শ্রমে এগোবো। এটাই নতুন বাংলাদেশের চেতনা।”
