পুরান ঢাকার ঐতিহাসিক লালবাগ কেল্লা আজ সন্ধ্যায় রূপ নিল সুর, আলো ও অনুভবের এক অনন্য মিলনমেলায়। উপমহাদেশীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের কিংবদন্তি গুরু, বিশিষ্ট সুরস্রষ্টা ও সংগীতাচার্য ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ’র ১৬৩তম জন্মবার্ষিকী উদ্যাপিত হলো সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ও বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির আয়োজনে।
সন্ধ্যা ৭টা ২০ মিনিটে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস-এর একটি হৃদয়স্পর্শী ভিডিও বার্তার মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠানটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়। বার্তায় তিনি বলেন, “ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ শুধু সংগীতশিল্পী ছিলেন না, তিনি ছিলেন এক যুগপ্রবর্তক। তাঁর উত্তরাধিকার আজও বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক চেতনার অবিচ্ছেদ্য অংশ।”
অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী, যিনি বলেন, “ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ইতিহাসের মূল সুর। তাঁর সৃষ্ট রাগ, তাঁর অনুশাসন ও তাঁর দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি আজও তরুণ প্রজন্মকে শুদ্ধতার পথে অনুপ্রাণিত করে।”
এছাড়াও বক্তৃতা করেন শিল্প এবং গৃহায়ন ও গণপূর্ত উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান, এবং পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন ও পানি সম্পদ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তারা সংগীতের মানবিক ও পরিবেশবান্ধব দিকগুলোর ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
সংগীত, প্রামাণ্যচিত্র ও প্রজন্মের মিলন
উদ্বোধনের পর সন্ধ্যা ৭টা ২৫ মিনিটে প্রদর্শিত হয় “ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ: সুরলোকের গুরুদেব” শীর্ষক প্রামাণ্যচিত্র, যেখানে তাঁর জীবন, কর্ম ও বিশ্বসংগীতে অবদানের অনন্য দিকগুলো তুলে ধরা হয়।
এরপর মঞ্চে পরিবেশিত হয় মনোমুগ্ধকর খেয়াল (রাগ ভীমপলশ্রী)—যার পরিবেশনায় ছিলেন বিশিষ্ট শাস্ত্রীয় গায়ক পণ্ডিত অসিত দে। এর পরপরই বাংলাদেশের নবীন প্রজন্মের শিল্পীরা তাঁদের গুরুদেবকে শ্রদ্ধা জানিয়ে সুরের শ্রদ্ধাঞ্জলি উপস্থাপন করেন।
ওস্তাদের প্রপৌত্র সিরাজ আলী খান এই আয়োজনে প্রধান আকর্ষণ হিসেবে পরিবেশন করেন একাধিক সরোদ সঙ্গীত। তাঁর বাজনায় ফুটে ওঠে গুরু আলাউদ্দিন খাঁ’র উত্তরাধিকার, নিখুঁত রাগনির্মাণ ও মর্মস্পর্শী মেলবন্ধন।
রাত ৮টা ৪৫ মিনিটে পরিবেশিত হয় রাগ কিরওয়ানি, পরিচালনায় ছিলেন মৈত্রী সরকার। এতে অংশ নেন বেঙ্গল পরম্পরা সঙ্গীতালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা—যাদের মধ্যে ছিলেন অভিজিৎ কুন্ডু (ধ্রুপদ), প্রশান্ত ভৌমিক (তবলা), ফাহমিদা নাজনীন (তবলা), শুক্লা হালদার (এস্রাজ), নিলয় হালদার (সারেঙ্গি), ইসরা ফুলঝুরি খান ও ইলহাম ফুলঝুরি খান (সরোদ), সোহিনী মজুমদার ও মোহাম্মাদ কাওছার (সেতার)।
আন্তর্জাতিক উপস্থিতি ও সম্মাননা প্রদান
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন জাপান, ইতালি, চায়না, পাকিস্তান, ভারত, ফিলিপাইন, বতসোয়ানা ও ইউনেস্কোসহ বিভিন্ন দেশের দূতাবাসের প্রতিনিধিবৃন্দ। তাঁরা ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ’র সংগীত ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক উদ্যোগের প্রশংসা করেন।
অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব (সিনিয়র সচিব পদমর্যাদা) মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম, সংস্কৃতি সচিব মো. মফিদুর রহমান, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক শেখ রেজাউদ্দিন আহমেদ (রেজাউদ্দিন স্টালিন), বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক তানজিম ইবনে ওয়াহাব, এবং বিভিন্ন সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও প্রশাসনিক ব্যক্তিত্ব।
অনুষ্ঠানে আফসানা খান (সেতার) ও রুখসানা খান (সরোদ) যুগলবন্দি পরিবেশন করে দর্শকদের মুগ্ধ করেন। পরে “ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ: এক কথোপকথন” পর্বে অংশ নেন বিশিষ্ট আলোকচিত্রী নাসির আলী মামুন, যিনি স্মৃতিচারণে বলেন, “ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ ছিলেন এক চলমান বিশ্ববিদ্যালয়। তাঁর কাছ থেকে শেখা মানে ছিল জীবনের সংগীত শেখা।”
অনুষ্ঠানের শেষ পর্বে ওস্তাদের প্রপৌত্র সিরাজ আলী খান-কে বিশেষ সম্মাননা প্রদান করা হয়। সমাপনী পরিবেশনায় তিনি সরোদে অনবদ্য শাস্ত্রীয় সঙ্গীত পরিবেশন করেন, সাথে তবলায় ছিলেন কল্লোল ঘোষ ও আর্চিক ব্যানার্জী।
সুর ও শ্রদ্ধায় পরিপূর্ণ এই আয়োজনে লালবাগ কেল্লা যেন ফিরে পেয়েছিল শতবর্ষ আগের সেই সুরলোকের আবহ, যেখানে সঙ্গীতই ছিল আত্মার ভাষা। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন জনপ্রিয় অভিনেতা আফজাল হোসেন ও উপস্থাপক মারিয়া ফারিহ্ উপমা।
