সিলেটের দক্ষিণ সুরমার মোগলাবাজার এলাকায় ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনার পর তদন্তে নেমেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। মঙ্গলবার সকালে চট্টগ্রাম থেকে ছেড়ে আসা উদয়ন এক্সপ্রেসের ইঞ্জিন ও তিনটি বগি লাইনচ্যুত হওয়ার ঘটনায় ট্রেনটির লোকোমাস্টার মো. ইলিয়াস ও সহকারী লোকোমাস্টার জহিরুল ইসলাম নোমানকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
দুর্ঘটনার পরই গঠন করা হয়েছে চার সদস্যের তদন্ত কমিটি। আগামী তিন দিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে নির্দেশ দিয়েছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ।
ঘটনার বিবরণ
মঙ্গলবার সকাল ৬টা ৪০ মিনিটের দিকে সিলেটের মোগলাবাজার রেলস্টেশনের কাছে দুর্ঘটনাটি ঘটে। চট্টগ্রাম থেকে ছেড়ে আসা উদয়ন এক্সপ্রেসের ইঞ্জিনসহ তিনটি বগি হঠাৎ লাইনচ্যুত হয়ে পাশের দিকে উল্টে যায়। এতে ট্রেনচালকসহ অন্তত কয়েকজন আহত হন। আহতদের মধ্যে দু’জনকে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
দুর্ঘটনার পরপরই সিলেটের সঙ্গে সারাদেশের রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। সকাল ১১টার দিকে জরুরি মেরামত শেষে আংশিকভাবে ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক হয়। প্রথমে ছেড়ে যায় ঢাকাগামী কালনী এক্সপ্রেস।
সিগন্যাল না মানাই দুর্ঘটনার মূল কারণ
রেলওয়ের প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে, দুর্ঘটনাটি ঘটেছে সিগন্যাল অমান্য করার কারণে। মঙ্গলবার সকাল ৬টা ১৫ মিনিটে কালনী এক্সপ্রেস সিলেট থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। কিছুক্ষণ পর মোগলাবাজার স্টেশনে ক্রসিং করার কথা ছিল বিপরীত দিক থেকে আসা উদয়ন এক্সপ্রেসের।
নির্ধারিত নিয়ম অনুযায়ী, কালনী এক্সপ্রেসকে মূল লাইনে অগ্রাধিকার দিতে উদয়ন এক্সপ্রেসকে লুপ লাইনে থামার সিগন্যাল দেওয়া হয়। কিন্তু ট্রেনটির লোকোমাস্টার সেই সিগন্যাল না মেনে লুপ লাইনে প্রবেশের চেষ্টা করেন। তীব্র গতিতে ইঞ্জিন ও তিনটি বগি ট্র্যাক থেকে ছিটকে পড়ে উল্টে যায়।
এই ঘটনার পর মুহূর্তেই থমকে যায় রেল চলাচল। রেলওয়ে সূত্রে জানা যায়, সিগন্যাল ভঙ্গ ও মানবিক ত্রুটির বিষয়টি প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত করা হয়েছে।
তদন্ত কমিটি গঠন ও বরখাস্ত দুইজন
দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে বাংলাদেশ রেলওয়ে চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। কমিটির নেতৃত্বে আছেন ঢাকা অঞ্চলের বিভাগীয় পরিবহন কর্মকর্তা। সদস্য হিসেবে রয়েছেন বিভাগীয় প্রকৌশলী-২, বিভাগীয় যান্ত্রিক প্রকৌশলী এবং বিভাগীয় সংকেত ও টেলিযোগাযোগ প্রকৌশলী।
তাদের তিন দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
এদিকে দুর্ঘটনার পর লোকোমাস্টার মো. ইলিয়াস এবং সহকারী লোকোমাস্টার জহিরুল ইসলাম নোমানকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
সিলেট রেলওয়ে স্টেশন ম্যানেজার নুরুল ইসলাম বলেন,
“প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, সিগন্যাল না মানার কারণেই ট্রেনটি লাইনচ্যুত হয়েছে। আমরা দ্রুত উদ্ধারকাজ সম্পন্ন করে ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক করেছি। তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে, রিপোর্টের পর পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
ঘটনাস্থল পরিদর্শন ও প্রশাসনের বক্তব্য
বিকেলে দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন সিলেটের জেলা প্রশাসক মো. সারওয়ার আলম। তিনি উদ্ধার কার্যক্রম ঘুরে দেখেন এবং স্থানীয় প্রশাসন ও রেলওয়ে কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেন।
জেলা প্রশাসক সাংবাদিকদের বলেন,
“এই ঘটনার পেছনে কারও গাফিলতি থাকলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পাশাপাশি রেললাইনের পাশের অবৈধ স্থাপনাগুলোও সরিয়ে ফেলার উদ্যোগ নেওয়া হবে।”
রেল নিরাপত্তা নিয়ে নতুন প্রশ্ন
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশে ট্রেন দুর্ঘটনার সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় রেলপথের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সিগন্যাল ব্যবস্থাপনা, ট্রেনচালকদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ এবং রেলপথের আধুনিকীকরণ এখন সময়ের দাবি।
মোগলাবাজারের এই দুর্ঘটনা সেই বাস্তবতাকেই আবারও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। তদন্ত প্রতিবেদনে কী উঠে আসে, তার ওপর নির্ভর করবে পরবর্তী পদক্ষেপ—তবে আপাতত পুরো দেশই তাকিয়ে আছে রেলওয়ের তদন্ত ফলাফলের দিকে।
