বাংলাদেশ ও সৌদি আরবের মধ্যে সাধারণ কর্মী নিয়োগ নিয়ে একটি যুগান্তকারী দ্বিপাক্ষিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। সোমবার (৬ অক্টোবর) রিয়াদে আয়োজিত অনুষ্ঠানে এই চুক্তিতে সই করেন দুই দেশের প্রতিনিধিরা।
বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল এবং সৌদি আরব সরকারের পক্ষে মানবসম্পদ ও সামাজিক উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার আহমেদ বিন সোলাইমান আল-রাজী চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন।
শ্রমবাজারে নতুন মাইলফলক
দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছরের ইতিহাসে এটি প্রথমবারের মতো সাধারণ কর্মী নিয়োগসংক্রান্ত আনুষ্ঠানিক চুক্তি। এর আগে বাংলাদেশ থেকে সৌদি আরবে কর্মী পাঠানো হতো অনানুষ্ঠানিকভাবে। ১৯৭৬ সালে প্রথমবারের মতো সৌদি আরবে শ্রমিক পাঠায় বাংলাদেশ। এরপর থেকে আজ পর্যন্ত প্রায় ৩০ লাখের বেশি বাংলাদেশি শ্রমিক সৌদি আরবে কর্মরত রয়েছেন।
সৌদি আরব বর্তমানে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রেমিট্যান্স উৎস। শুধুমাত্র এই দেশ থেকেই প্রতি বছর প্রায় ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার দেশে পাঠান প্রবাসীরা।
চুক্তির তাৎপর্য ও নতুন সুযোগ
চুক্তি অনুযায়ী, এখন থেকে বাংলাদেশ থেকে দক্ষ, আধা-দক্ষ ও সাধারণ কর্মী— তিন ধরনের শ্রমিকই সৌদি আরবে পাঠানো যাবে। নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা, দক্ষতা যাচাই, প্রশিক্ষণ এবং কর্মী সুরক্ষা নিশ্চিত করার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
চুক্তি কার্যকর হলে আগামী দুই বছরের মধ্যে সৌদি আরবে বাংলাদেশের কর্মী সংখ্যা অন্তত ২০ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে, জানিয়েছেন প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
ড. আসিফ নজরুল বলেন,
“বাংলাদেশ থেকে দক্ষ কর্মী প্রেরণের আগে আমরা প্রশিক্ষণ ও স্কিল সার্টিফিকেশন নিশ্চিত করব। এতে সৌদি আরব আরও গুণগত শ্রমশক্তি পাবে এবং আমাদের কর্মীরা ভালো বেতন ও কর্মপরিবেশ উপভোগ করতে পারবে।”
সৌদি সরকারের প্রশংসা ও প্রত্যাশা
চুক্তি স্বাক্ষরের পর সৌদি মানবসম্পদ ও সামাজিক উন্নয়ন মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার আহমেদ বিন সোলাইমান আল-রাজী বলেন,
“বাংলাদেশ আমাদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শ্রমবাজার অংশীদার। এই চুক্তি শুধু নিয়োগ নয়, বরং মানবসম্পদ উন্নয়ন ও দক্ষতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে নতুন অধ্যায় সূচনা করবে।”
তিনি আরও যোগ করেন, দুই দেশের মন্ত্রণালয়গুলো একসঙ্গে কাজ করে কর্মী কল্যাণ, আইনি সুরক্ষা, চিকিৎসা ও আবাসন সুবিধা নিশ্চিত করবে।
অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে জোর
চুক্তি অনুযায়ী, এখন থেকে নিয়োগকর্তা ও কর্মীর মধ্যে চুক্তিভিত্তিক সম্পর্ক, আকামা নবায়ন, এবং সময়সীমার মধ্যে এক্সিট ভিসা প্রদানের প্রক্রিয়া বাধ্যতামূলকভাবে অনুসরণ করতে হবে।
বাংলাদেশি কর্মীদের অধিকার রক্ষায় সৌদি আরব ও বাংলাদেশ যৌথভাবে মনিটরিং ব্যবস্থা চালু করবে। এতে অবৈধ দালাল চক্র দমন ও ডিজিটাল যাচাইকরণ ব্যবস্থা কার্যকরভাবে প্রয়োগের পরিকল্পনাও রয়েছে।
এ ছাড়া নারী কর্মীদের সুরক্ষা, নিরাপদ অভিবাসন ব্যবস্থা ও যৌথ প্রশিক্ষণকেন্দ্র স্থাপন বিষয়েও বৈঠকে বিস্তারিত আলোচনা হয়।
উপস্থিতি ও প্রতিক্রিয়া
চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে সৌদি আরবে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মো. দেলওয়ার হোসেন, মিশন উপপ্রধান এস. এম. নাজমুল হাসান, শ্রম কাউন্সেলর মুহাম্মাদ রেজায়ে রাব্বীসহ দুই দেশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
বাংলাদেশ সরকার আশা করছে, এই চুক্তির মাধ্যমে শুধু কর্মসংস্থানের সুযোগই বাড়বে না, বরং দক্ষ কর্মী রপ্তানিতে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আরও উজ্জ্বল হবে।
প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন,
“দক্ষ কর্মী রপ্তানি কেবল রেমিট্যান্স বাড়াবে না, বরং বাংলাদেশের বৈদেশিক সম্পর্ক, কূটনৈতিক অবস্থান এবং শ্রমবাজারে প্রতিযোগিতা শক্তিশালী করবে।”
অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব
বর্তমানে প্রায় ২৭ লাখ বাংলাদেশি কর্মী সৌদি আরবে কর্মরত আছেন। নতুন এই চুক্তির ফলে আগামী দুই বছরে আরও ৫ লাখ নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
চুক্তি বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশি কর্মীরা দক্ষতা অনুযায়ী উন্নত বেতন, আবাসন ও চিকিৎসা সুবিধা পাবেন। একই সঙ্গে উভয় দেশ যৌথ অনলাইন ডেটা প্ল্যাটফর্ম তৈরি করবে, যেখানে প্রতিটি নিয়োগ ও কর্মচুক্তির তথ্য সংরক্ষিত থাকবে— যা স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করবে।
সমাপনী বিশ্লেষণ
শ্রমবাজার সম্প্রসারণে এ চুক্তি বাংলাদেশের জন্য এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এটি শুধু রেমিট্যান্স আয় বাড়াবে না, বরং মানবসম্পদ উন্নয়নের নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি করবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই পদক্ষেপ বাংলাদেশের অর্থনীতি ও পররাষ্ট্রনীতিতে এক নতুন দিগন্তের সূচনা করবে।
