নীলফামারীতে তিস্তা নদীর পানি হঠাৎ বেড়ে বিপৎসীমা অতিক্রম করেছে। রোববার সন্ধ্যা ৬টায় ডালিয়া ব্যারাজ পয়েন্টে নদীর পানি বিপৎসীমার ১৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয় বলে নিশ্চিত করেছে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। এতে জেলার ডিমলা উপজেলার অন্তত সাতটি ইউনিয়নের ১৫টি গ্রাম ও চরাঞ্চলের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে।
পাউবো সূত্রে জানা গেছে, রোববার সকাল ৬টায় তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে নদীর পানি বিপৎসীমার ৭২ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। মাত্র ১২ ঘণ্টার ব্যবধানে পানি বেড়ে বিপৎসীমার ওপরে চলে যায়। ওই পয়েন্টে নদীর বিপৎসীমা ৫২ দশমিক ১৫ মিটার। সন্ধ্যা নাগাদ পানির স্তর দাঁড়ায় ৫২ দশমিক ২৮ মিটারে।
পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী অমিতাভ চৌধুরী জানান, “উজানের ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলের কারণে তিস্তা নদীতে পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। সন্ধ্যা ছয়টায় ব্যারাজ পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ১৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল।”
তিনি আরও বলেন, পানির প্রবল চাপে তিস্তা ব্যারাজের উজানে জিরো পয়েন্ট এলাকার কালীগঞ্জ নামক স্থানে ডান তীরের প্রধান বাঁধে ভাঙন দেখা দিয়েছে। “পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে বাঁশের পাইলিং, বালির বস্তা ফেলা ও জিও ব্যাগ ব্যবহারের কাজ অব্যাহত আছে,” বলেন তিনি।
এদিকে, তিস্তা নদীর পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করায় ডিমলা উপজেলার পূর্ব ছাতনাই, পশ্চিম ছাতনাই, খগাখড়িবাড়ি, টেপাখড়িবাড়ি, গয়াবাড়ি, খালিশাচাপানী ও ঝুনাগাছ চাপানী ইউনিয়নের বহু গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এসব এলাকার নিম্নাঞ্চল ও চরাঞ্চলে পানি ঢুকে পড়েছে, ডুবে গেছে শত শত রোপা আমন ক্ষেত ও ঘরবাড়ি।
ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার চিত্র
ডিমলার পূর্ব ছাতনাই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল লতিফ খান বলেন, “রোববার দুপুরের পর থেকেই নদীর পানি দ্রুত বাড়তে থাকে। ইউনিয়নের ঝাড়সিংহেরশ্বর, পূর্ব ছাতনাই গ্রামের বোল্ডারের চর, খোকার চর, খাড়াপাড়া ও ফ্লাটপাড়াসহ তিস্তা পাড়ের নিম্নাঞ্চল এখন পানির নিচে। অনেকের বাড়িঘরে পানি ঢুকে পড়েছে।”
একইভাবে টেপাখড়িবাড়ি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. রবিউল ইসলাম জানান, “তিস্তার পানি বৃদ্ধির ফলে রোপা আমন ক্ষেত তলিয়ে গেছে। চর ও নিম্নাঞ্চলের বহু পরিবার ঘরবাড়ি ছেড়ে নিরাপদ স্থানে সরে যাচ্ছেন।”
ব্যারাজের সব জলকপাট খুলে দেয়া হয়েছে
ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, রোববার সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত নদীর পানির স্তর ক্রমাগত বেড়েছে—
- সকাল ৬টায়: ৫১.৪৩ মিটার
- সকাল ৯টায়: ৫১.৪৮ মিটার
- দুপুর ১২টায়: ৫২.০০ মিটার
- বিকেল ৩টায়: ৫২.১৪ মিটার
- সন্ধ্যা ৬টায়: ৫২.২৮ মিটার
পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে ব্যারাজের সব ৪৪টি জলকপাট খুলে দেয়া হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন নির্বাহী প্রকৌশলী অমিতাভ চৌধুরী। তিনি জানান, “জলকপাট খোলা থাকায় পানির প্রবাহ বাড়লেও, তা নদীর দুই তীরে চাপ কিছুটা কমাবে বলে আশা করছি।”
জনদুর্ভোগ বাড়ছে, নজরদারিতে প্রশাসন
পানির ঢলে ডিমলা উপজেলার বিভিন্ন চরাঞ্চলে মানুষের দুর্ভোগ বেড়েছে। গ্রামের বহু কাঁচা ঘরে পানি ঢুকেছে, অনেকে রান্না-বান্না বন্ধ রেখে আশ্রয় নিয়েছেন উঁচু স্থানে। অনেক এলাকায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।
স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পর্যবেক্ষণ ও ত্রাণ সহায়তার প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। ডিমলা উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা বলেন, “যদি পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকে, তাহলে দ্রুত আশ্রয়কেন্দ্র খুলে দেয়া হবে।”
আগাম সতর্কতা জারি
পাউবো সূত্র জানায়, উজানে ভারী বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকায় তিস্তার পানি আরও কিছুটা বাড়তে পারে। তাই নদী তীরবর্তী এলাকাগুলোর বাসিন্দাদের সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে যেন তারা নিয়মিত ভাঙনপ্রবণ এলাকা পর্যবেক্ষণ করেন এবং কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে দ্রুত ব্যবস্থা নেন।
বন্যা পূর্বাভাস কেন্দ্রের কর্মকর্তাদের মতে, “তিস্তার পানি বিপৎসীমার ওপরে গেলেও পরিস্থিতি এখনো নিয়ন্ত্রণে আছে। তবে অব্যাহত বর্ষণ থাকলে নিম্নাঞ্চলে নতুন করে বন্যার ঝুঁকি দেখা দিতে পারে।”
