দেশের কর প্রশাসনে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বাড়াতে মাঠ পর্যায়ে গোয়েন্দা কার্যক্রম জোরদার করতে নতুন নির্দেশনা দিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। কর ফাঁকি শনাক্ত, ফাঁকি দেওয়া রাজস্ব পুনরুদ্ধার ও সম্ভাব্য অনিয়ম প্রতিরোধে প্রতিটি কর অঞ্চলে ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন সেল (আইআইসি) গঠনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এনবিআরের সদস্য (কর অডিট, ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন) দফতর থেকে সম্প্রতি পাঠানো নির্দেশনায় এই বিষয়গুলো বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে কর অঞ্চলগুলোর জন্য গোয়েন্দা কার্যক্রমের কাঠামো, টিম গঠনের নিয়ম, তদন্ত পদ্ধতি, সুপারিশ তৈরির প্রক্রিয়া এবং ফাঁকি দেওয়া রাজস্ব পুনরুদ্ধারের জন্য অনুমোদন ব্যবস্থা নির্ধারণ করা হয়েছে।
কর ফাঁকি ধরতে গঠিত হবে বিশেষ টিম
নির্দেশনা অনুযায়ী, প্রতিটি কর অঞ্চল এখন থেকে নিজস্ব ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন সেল (আইআইসি) গঠন করবে। এই টিম মাঠ পর্যায়ে কর ফাঁকির বিভিন্ন সূত্র—যেমন করদাতার আয়কর নথিতে অস্বাভাবিক পরিবর্তন, সম্পদ বিবরণীতে অপ্রত্যাশিত বৃদ্ধি, প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার প্রতিবেদন বা বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া অভিযোগ—পর্যালোচনা করে তদন্ত শুরু করবে।
নির্দেশনায় আরও বলা হয়েছে, কোনো করদাতার আয় ও ব্যয়ের মধ্যে অসামঞ্জস্য, নথিপত্রে ঘষা-মাজা, অস্বাভাবিক করমুক্ত আয় বা ঘোষিত আয় ও কর প্রদানের সঙ্গে সম্পদের অসামঞ্জস্য দেখা গেলে, সেটিকে তদন্তের আওতায় আনতে হবে।
একজন এনবিআর কর্মকর্তা বলেন, “আগে অনেক ক্ষেত্রেই তথ্য ছিল, কিন্তু তা অনুসন্ধানে নিয়মিত কাঠামো ছিল না। এখন প্রতিটি অঞ্চলে নিজস্ব গোয়েন্দা টিম থাকায় কর ফাঁকি শনাক্ত ও পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া অনেক দ্রুত হবে।”
তদন্তে থাকবে তিন ধাপের প্রক্রিয়া
তদন্ত কার্যক্রম তিন ধাপে সম্পন্ন হবে বলে জানা গেছে। প্রথমে মাঠ পর্যায়ের আইআইসি টিম কর ফাঁকির প্রাথমিক তথ্য যাচাই করে প্রতিবেদন দেবে। দ্বিতীয় ধাপে ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন কমিটি (আইআইসি কমিটি) প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করবে এবং পর্যাপ্ত প্রমাণ পাওয়া গেলে চূড়ান্ত সুপারিশ করবে। তৃতীয় ধাপে সংশ্লিষ্ট কর কমিশনারেট সেই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে আইনি ব্যবস্থা নিতে পারবে।
একই সঙ্গে এনবিআর নির্দেশনায় বলা হয়েছে, রাজস্ব পুনরুদ্ধার সংক্রান্ত যেকোনো পদক্ষেপ নেওয়ার আগে সংশ্লিষ্ট কমিটির অনুমোদন বাধ্যতামূলক। এভাবে রাজস্ব ফাঁকি শনাক্ত হওয়ার পর তাৎক্ষণিক আইনগত ব্যবস্থা নিশ্চিত করার পথ তৈরি হবে।
মাসিক অগ্রগতি প্রতিবেদন বাধ্যতামূলক
নির্দেশনায় বলা হয়েছে, প্রতিটি কর কমিশনারেটকে প্রতি মাসে নির্ধারিত ছকে গোয়েন্দা কার্যক্রমের অগ্রগতি প্রতিবেদন প্রস্তুত করতে হবে। এই প্রতিবেদনে অন্তর্ভুক্ত থাকবে —
- চলতি মাসে তদন্ত শুরু ও শেষ হওয়া মামলার সংখ্যা,
- শনাক্ত রাজস্ব ফাঁকির পরিমাণ,
- অতিরিক্ত কর দাবি, এবং
- আদায় করা টাকার বিস্তারিত তথ্য।
প্রতিটি অঞ্চলকে পরবর্তী মাসের ১০ তারিখের মধ্যে সেই প্রতিবেদন এনবিআরের কাছে পাঠাতে হবে। বোর্ডের কেন্দ্রীয় দফতর থেকে মাসিক এই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে সারাদেশের গোয়েন্দা কার্যক্রম তদারকি করা হবে।
সুষ্ঠু কর সংস্কৃতি গঠনের প্রত্যাশা
এনবিআরের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “গোয়েন্দা কার্যক্রমের এই নতুন কাঠামো কর প্রশাসনে জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা বাড়াবে। এতে একদিকে কর ফাঁকির প্রবণতা কমবে, অন্যদিকে সৎ করদাতারা উৎসাহিত হবেন নিয়মিত কর পরিশোধে।”
রাজস্ব বোর্ড আরও আশা করছে, মাঠ পর্যায়ে গোয়েন্দা তৎপরতা জোরদার হলে দেশের অভ্যন্তরীণ রাজস্ব প্রবৃদ্ধি বাড়বে এবং কর ফাঁকি থেকে হারানো রাজস্ব পুনরুদ্ধার সম্ভব হবে।
এক অর্থনীতিবিদ মন্তব্য করেছেন, “এই উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে কর প্রশাসনে পদ্ধতিগত শৃঙ্খলা ফিরবে। গোয়েন্দা নজরদারি বাড়লে কর ফাঁকিবাজদের নিরুৎসাহিত করবে এবং এটি সৎ করদাতাদের জন্য একটি ন্যায্য পরিবেশ তৈরি করবে।”
রাজস্ব আহরণে নতুন কৌশল
দেশে বর্তমানে মোট রাজস্ব আয়ের প্রায় ৩৫ শতাংশই আসে আয়কর থেকে। কিন্তু এনবিআর সূত্র অনুযায়ী, বিপুলসংখ্যক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান এখনো নিয়মিত আয়কর দিচ্ছে না বা আয় গোপন করছে। এ অবস্থায় গোয়েন্দা কার্যক্রম জোরদার করা হচ্ছে রাজস্ব আহরণে নতুন কৌশল হিসেবে।
এনবিআরের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, “গোয়েন্দা তথ্য ও প্রযুক্তিভিত্তিক কর প্রশাসনই ভবিষ্যতের রাজস্ব ব্যবস্থাপনার মূল হাতিয়ার। নতুন নির্দেশনা মাঠ পর্যায়ে কার্যকর হলে আমরা বছরে কয়েক হাজার কোটি টাকার রাজস্ব পুনরুদ্ধার করতে পারব।”
