ভেনিজুয়েলা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এমন একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, যা নিয়ে ওয়াশিংটন ও কারাকাসের মধ্যে ইতিমধ্যেই নতুন উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে। তবে তাঁর সিদ্ধান্তের প্রকৃতি কী—সেটি স্পষ্ট করে জানাতে রাজি হননি ট্রাম্প। ফ্লোরিডা ভ্রমণকালে এয়ার ফোর্স ওয়ানে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, “আমি ভেনিজুয়েলা বিষয়ে একরকম সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এখনই বিস্তারিত বলতে পারছি না। তবে মাদক চোরাচালান বন্ধের ক্ষেত্রে আমরা উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছি।”
ট্রাম্পের এ বক্তব্য এমন এক সময় এলো, যখন ওয়াশিংটন ল্যাটিন আমেরিকার বিভিন্ন অঞ্চলে যুদ্ধজাহাজ, সামরিক বিমান এবং হাজারেরও বেশি মার্কিন সেনা মোতায়েন করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের দাবি—এ উদ্যোগের মূল লক্ষ্য মাদকবিরোধী অভিযান শক্তিশালী করা। অন্যদিকে, ভেনিজুয়েলার মতে, এটি স্পষ্টভাবেই শাসনব্যবস্থা পরিবর্তনের ‘ছদ্মবেশি প্রস্তুতি’।
মাদকবিরোধী অভিযানের আড়ালে সামরিক উপস্থিতি
যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক সামরিক মোতায়েনের মধ্যে ক্যারিবীয় সাগরে যুদ্ধজাহাজ ও নবীনতম প্রযুক্তির নৌযান অন্তর্ভুক্ত। মার্কিন সেনাবাহিনী জানিয়েছে, মাদক চোরাচালানবিরোধী অভিযানের অংশ হিসেবে এ পর্যন্ত ২১টি সন্দেহজনক নৌকায় আক্রমণ চালিয়ে কমপক্ষে ৮০ জনকে হত্যা করা হয়েছে।
এ ছাড়া পুয়ের্তো রিকোতে পাঠানো হয়েছে আধুনিক এফ-৩৫ স্টিলথ যুদ্ধবিমান, যা সাধারণত উচ্চসংবেদনশীল অপারেশন ছাড়া অন্য কোথাও মোতায়েন করা হয় না। বিশ্লেষকদের মতে, মাদকবিরোধী অভিযানকে যুক্তরাষ্ট্র যে কৌশলগতভাবে ব্যবহার করছে—এ মোতায়েন সে দাবির আরও প্রমাণ।
মঙ্গলবার বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিমানবাহী জাহাজ ইউএসএস জেরাল্ড আর. ফোর্ড ল্যাটিন আমেরিকায় পৌঁছেছে। ওয়াশিংটন বলছে—এ জাহাজ স্থানীয় দেশগুলোকে মাদক পাচার রোধে সহায়তা করবে। তবে কারাকাস এ পদক্ষেপকে ‘স্পষ্ট হুমকি’ হিসেবে দেখছে, কারণ যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ভেনিজুয়েলার সম্পর্ক কয়েক বছর ধরেই তীব্র উত্তেজনায় রয়েছে।
ভেনিজুয়েলার তেলসম্পদ লক্ষ্য—এমন আশঙ্কা ল্যাটিন আমেরিকায়
ল্যাটিন আমেরিকার অনেক দেশই মনে করে, যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উপস্থিতি শুধু মাদকবিরোধী অভিযান নয়—বরং বৃহত্তর ভূরাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনের অংশ। কলম্বিয়ার প্রথম বামপন্থী প্রেসিডেন্ট গুস্তাভো পেট্রো অভিযোগ করেছেন, ওয়াশিংটনের প্রকৃত উদ্দেশ্য হলো ভেনিজুয়েলার বিপুল তেলসম্পদে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা এবং পুরো অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করে তোলা।
পেট্রো বলেন, “এই সামরিক মোতায়েনের শেষ লক্ষ্য তেল। মাদকবিরোধী অভিযানের যুক্তি তুলে ধরলেও উদ্দেশ্য অনেক গভীর।” তাঁর মতে, যুক্তরাষ্ট্র আবারও ঠাণ্ডাযুদ্ধ-পরবর্তী পুরোনো প্রভাব বিস্তারের রাজনীতি ফিরিয়ে আনছে।
ভেনিজুয়েলার পাল্টা প্রস্তুতি—দেশজুড়ে সেনা মোতায়েন
উপকূলে বাড়তে থাকা মার্কিন নৌ উপস্থিতিকে ‘সরাসরি হুমকি’ হিসেবে বিবেচনা করছে নিকোলাস মাদুরোর সরকার। কারাকাস জানিয়েছে, তারা দেশব্যাপী সামরিক বাহিনী মোতায়েন শুরু করেছে, বিশেষ করে সমুদ্রসীমা ও সীমান্ত এলাকায় নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।
ভেনিজুয়েলার প্রতিরক্ষামন্ত্রী জানিয়েছেন, শাসনব্যবস্থা পরিবর্তনের যেকোনো সম্ভাব্য প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে দেশ প্রস্তুত। “আমরা কোনো উস্কানি বরদাস্ত করব না,” তিনি বলেন।
সম্ভাব্য সামরিক অভিযানের ‘অপশন’ হোয়াইট হাউসে আলোচনায়
আমেরিকান টেলিভিশন নেটওয়ার্ক সিবিএস নিউজ জানিয়েছে, একাধিক সূত্রের বরাতে তারা নিশ্চিত হয়েছে যে, মার্কিন সামরিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ইতোমধ্যেই ট্রাম্পকে ভেনিজুয়েলায় সম্ভাব্য অভিযানের বিভিন্ন বিকল্প উপস্থাপন করেছেন। এসব বিকল্পের মধ্যে স্থলপথে হামলাও রয়েছে—যা পরিস্থিতিকে আরও অস্থিতিশীল করতে পারে।
যদিও গত ২ নভেম্বর এক সাক্ষাৎকারে ট্রাম্প যুদ্ধের সম্ভাবনা উড়িয়ে দিয়েছিলেন, কিন্তু মাদুরোকে ‘মাদক সম্রাট’ হিসেবে আখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, “তার দিন ফুরিয়ে গেছে।” তাই সামরিক সমাধান পুরোপুরি বাতিল হয়নি বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
আঞ্চলিক উত্তেজনা বাড়ার শঙ্কা
বিশেষজ্ঞদের মতে, ভেনিজুয়েলা শুধু তেলসমৃদ্ধ দেশই নয়, বরং রাশিয়া, তুরস্ক ও ইরানের মতো মার্কিন-বিরোধী বেশ কয়েকটি রাষ্ট্রের কৌশলগত মিত্র। তাই দেশটিতে যেকোনো সামরিক অভিযানের প্রভাব ল্যাটিন আমেরিকার বাইরে আরও বড় আন্তর্জাতিক সংঘাতে রূপ নিতে পারে।
এদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উপস্থিতি বাড়তে থাকায় অঞ্চলে সাধারণ মানুষের ভরসা কমছে। অনেকে আশঙ্কা করছেন, নতুন কোনো হস্তক্ষেপ আবারও ল্যাটিন আমেরিকাকে দীর্ঘমেয়াদী অস্থিতিশীলতার দিকে ঠেলে দিতে পারে।











সত্যের সন্ধানে আমরা — NRD News Media Limited