শীতের কঠিন সময় সামনে রেখে জ্বালানি সংকট মোকাবিলায় নতুন উদ্যোগ নিয়েছে ইউক্রেন। দেশটির প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি জানিয়েছেন, প্রথমবারের মতো গ্রিস থেকে প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি করবে ইউক্রেন। রাশিয়ার ধারাবাহিক হামলায় অবকাঠামো মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি। কিয়েভ থেকে দেওয়া এক বিবৃতিতে জেলেনস্কি বলেন, ইউক্রেন এখন এমন এক পরিস্থিতিতে রয়েছে যেখানে বিকল্প জ্বালানি সরবরাহই হতে পারে টিকে থাকার একমাত্র উপায়।
রাশিয়ার হামলায় উৎপাদনে ভয়াবহ পতন
গত অক্টোবর মাসে রাশিয়া ইউক্রেনের গ্যাস স্থাপনাগুলোর ওপর ২০২২ সালে পূর্ণমাত্রায় আগ্রাসন শুরুর পর থেকে সবচেয়ে বড় আক্রমণ চালায়। ক্ষেপণাস্ত্র হামলা এবং ড্রোন হামলার সমন্বয়ে পরিচালিত সেই অভিযানে ইউক্রেনের গুরুত্বপূর্ণ গ্যাস উৎপাদন স্থাপনাগুলো ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, এ আক্রমণের ফলে দেশের মোট জ্বালানি উৎপাদনের প্রায় ৬০ শতাংশ হ্রাস পায়, যা শীতকালীন সময়ে মারাত্মক সংকট তৈরির আশঙ্কা তৈরি করেছে।
ইউক্রেনের জ্বালানি খাতের কর্মকর্তারা বলছেন, গ্যাস উৎপাদন কমে যাওয়ায় শুধু গৃহস্থালি খাতই নয়, শিল্প এবং পরিবহন ব্যবস্থাও মারাত্মকভাবে প্রভাবিত হয়েছে। যুদ্ধের মধ্যেও সাধারণ মানুষের ঘরবাড়ি উষ্ণ রাখার প্রয়োজনীয়তা বিবেচনায় সরকার বিশেষ ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হয়েছে।
গ্রিসের সঙ্গে নতুন জ্বালানি চুক্তি
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া এক পোস্টে প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি জানান, গ্রিসের সঙ্গে গ্যাস সরবরাহের একটি পূর্ণাঙ্গ চুক্তি প্রস্তুত করা হয়েছে। এটি কার্যকর হলে গ্রিস ইউক্রেনে সরাসরি গ্যাস সরবরাহ করা শুরু করবে। জরুরি ভিত্তিতে নেওয়া এ উদ্যোগ শীতকালীন মাসগুলো পার হওয়ার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন তিনি।
বিশ্লেষকদের মতে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য দেশগুলোর সঙ্গে ইউক্রেনের এ ধরনের সহযোগিতা কিয়েভের কূটনৈতিক অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করবে। একইসঙ্গে ইউক্রেন–ইইউ জ্বালানি ব্যবস্থার সংযোগ বাড়ানোর ক্ষেত্রেও এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
দুই বিলিয়ন ইউরোর ঘাটতি পূরণে যৌথ অর্থায়ন
রাশিয়ার সাম্প্রতিক হামলায় জ্বালানি উৎপাদনে ব্যাপক ক্ষতি হওয়ায় ইউক্রেনের বাজেটে বিশাল ঘাটতি তৈরি হয়েছে। জেলেনস্কি জানান, প্রায় দুই বিলিয়ন ইউরো (২.৩২ বিলিয়ন ডলার) ঘাটতি পূরণের জন্য ইউক্রেন ইতোমধ্যে একটি অর্থায়ন চুক্তি সম্পন্ন করেছে।
এই অর্থ আসছে—
- ইউক্রেন সরকার,
- ইউরোপীয় কমিশনের গ্যারান্টিতে পরিচালিত ইউরোপীয় ব্যাংক,
- ইউক্রেনের বাণিজ্যিক ব্যাংক, এবং
- নরওয়ে সরকারের সহায়তা থেকে।
অর্থনৈতিক সহযোগিতার এই কাঠামো ইউক্রেনের জ্বালানি খাতের জরুরি পুনর্গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে বিশ্লেষকদের ধারণা।
আজারবাইজানের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি গ্যাসচুক্তির আশা
গ্রিসের পাশাপাশি ইউক্রেন বিকল্প জ্বালানি উৎসের খোঁজে আরও বিভিন্ন দেশের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। জেলেনস্কি জানান, তিনি আজারবাইজানের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে আলোচনা করছেন এবং দেশটি থেকে গ্যাস আমদানির জন্য একটি দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতে পৌঁছানোর ব্যাপারে আশাবাদী।
আজারবাইজান ইতোমধ্যেই ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশে জ্বালানি সরবরাহ করে। সে কারণে, দেশটির সঙ্গে সম্ভাব্য চুক্তি ইউক্রেনের ভবিষ্যৎ জ্বালানি নিরাপত্তার জন্য কৌশলগত সুবিধা এনে দিতে পারে।
দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা—কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে
ইউক্রেনে শীতকাল মানেই তীব্র ঠাণ্ডা। তাপমাত্রা শূন্য ডিগ্রির নিচে নেমে যাওয়ার সময় জ্বালানির চাহিদা কয়েকগুণ বেড়ে যায়। রাশিয়ার হামলায় জাতীয় গ্রিড এবং গ্যাস স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় এই মৌসুমে মানুষকে গরম রাখার ব্যবস্থা করাই সরকারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
সরকার বলছে, দ্রুত মেরামত কাজ চলছে, তবে যুদ্ধাবস্থায় প্রতিটি মেরামতকাজই বিশাল ঝুঁকির। এ কারণে বিকল্প জ্বালানি উৎস ছাড়া শীতকাল পার করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
বিশ্লেষকদের মতামত
আঞ্চলিক রাজনীতি বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ইউক্রেনের এ উদ্যোগ দেশটির আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে আরও গতিশীল করবে। রাশিয়ার জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমিয়ে ইউরোপের অন্যান্য দেশের সঙ্গে জ্বালানি সংযোগ স্থাপন করলে ইউক্রেন ভবিষ্যতে আরও নিরাপদ অবস্থানে থাকতে পারবে।
গ্যাস আমদানি চুক্তি শুধু শীতকালীন সংকট মোকাবিলাই নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদে ইউক্রেনের জ্বালানি খাতের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতেও ভূমিকা রাখবে বলে তাদের ধারণা।











সত্যের সন্ধানে আমরা — NRD News Media Limited