মালয়েশিয়া–থাইল্যান্ড সীমান্তের কাছে অবৈধভাবে সমুদ্রপথে অভিবাসনচেষ্টা চলাকালে প্রায় ৯০ জন অভিবাসী বহনকারী একটি নৌকা ডুবে গেছে। রোববার দেশটির পুলিশ এ তথ্য নিশ্চিত করেছে। নৌকাডুবির ঘটনায় একজন নারী মারা গেছেন, আর ছয়জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। বাকি যাত্রীদের সন্ধানে চলছে তৎপরতা।
আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা এএফপি জানিয়েছে, কারা এই যাত্রীরা—তা এখনও নিশ্চিত নয়। তবে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, যাত্রীরা অধিকাংশই দক্ষিণ এশিয়া ও মিয়ানমার অঞ্চলের অভিবাসী, যারা মালয়েশিয়ায় কাজের সন্ধানে সমুদ্রপথে বিপদজনক যাত্রা করে থাকেন।
তিন দিন আগে ঘটেছে দুর্ঘটনা
মালয়েশিয়ার কেদাহ প্রদেশের পুলিশ প্রধান আদজলি আবু শাহ স্থানীয় গণমাধ্যমকে জানান, নৌকাটি উল্টে যাওয়ার ঘটনাটি প্রায় তিন দিন আগে ঘটেছে বলে মনে করা হচ্ছে।
তিনি বলেন—
“ধারণা করা হচ্ছে নৌকাটি তিন দিন আগে ডুবে গেছে। যাদের উদ্ধার করা হয়েছে তারা বেশ দুর্বল অবস্থায় ছিলেন। এখনও অনেকে নিখোঁজ রয়েছেন।”
পুলিশ জানায়, উদ্ধার করা ছয়জনই গভীর ক্লান্তি, পানিশূন্যতা ও শারীরিক আঘাতে ভুগছিলেন। তাদের স্থানীয় হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
নিখোঁজ আরও দুই নৌকা
পুলিশ প্রধান আরও জানান, একই সময়ে যাত্রা করা একই রকম যাত্রীসংখ্যা বহনকারী আরও দুটি নৌকা নিখোঁজ হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এর অর্থ, সাগরে নিখোঁজ মানুষের সংখ্যা এক শতাধিকও ছাড়িয়ে যেতে পারে।
তিনি বলেন,
“তিনটি নৌকা একইসঙ্গে যাত্রা করেছিল বলে আমরা বিশ্বাস করছি। একটি নৌকা ডুবে গেছে, বাকি দুইটির এখনো কোনো সন্ধান নেই।”
এ অবস্থায় নিখোঁজ ব্যক্তিদের আত্মীয়স্বজন এবং মানবাধিকার সংগঠনগুলো গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
উদ্ধার অভিযান অব্যাহত
মালয়েশিয়ার সামুদ্রিক পুলিশ, উপকূলরক্ষী বাহিনী এবং কেদাহ রাজ্য পুলিশের যৌথ সমন্বয়ে নৌকাডুবিস্থলের আশেপাশে ব্যাপক অনুসন্ধান অভিযান চলছে। হেলিকপ্টার ও টহল নৌযান ইতোমধ্যেই ঘটনাস্থলে নামানো হয়েছে।
পুলিশ প্রধান জানিয়েছেন—
“উদ্ধার অভিযান আজও চলছে। সমুদ্র উত্তাল হওয়ায় অভিযানে চ্যালেঞ্জ রয়েছে, তবে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি।”
স্থানীয় জেলেরা জানিয়েছেন, গত কয়েকদিনে সমুদ্রের পরিস্থিতি খারাপ ছিল। তাই নৌকাটি ভারসাম্য হারিয়ে ডুবে যেতে পারে।
সমুদ্রপথে অভিবাসনের ঝুঁকি বাড়ছে
মালয়েশিয়া দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অভিবাসী শ্রমিকদের প্রধান গন্তব্যস্থল। বিশেষ করে বাংলাদেশ, মিয়ানমার (রোহিঙ্গা), নেপাল ও ইন্দোনেশিয়া থেকে প্রতি বছর হাজারো মানুষ অনিয়মিত পথে মালয়েশিয়ায় প্রবেশের চেষ্টা করে থাকে।
মানবাধিকার সংগঠনগুলোর মতে, সাগরপথে পাচারকারীদের মাধ্যমে যাত্রা করা অভিবাসীদের জীবন সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ থাকে। ছোট অবস্থা ভাঙাচোরা নৌকায় অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই করে দীর্ঘ দূরত্ব পাড়ি দিতে গিয়ে প্রায়ই এমন দুর্ঘটনা ঘটে।
জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে,
গত এক দশকে বঙ্গোপসাগর–আন্দামান সাগর অঞ্চলে নৌকাডুবিতে তিন হাজারেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে।
পাচারকারীদের নতুন রুট: মালয়েশিয়া–থাইল্যান্ড সীমান্ত
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আঞ্চলিক নিরাপত্তা কঠোর হওয়ায় পাচারকারীরা নতুন রুট হিসেবে মালয়েশিয়া–থাইল্যান্ড সীমান্ত ঘেঁষা ছোট ছোট উপসাগর ব্যবহার করছে। সীমান্তবর্তী এই অঞ্চলটি জঙ্গলে ঘেরা এবং পাহাড়ি হওয়ায় নজরদারি কম। ফলে মানবপাচারকারীদের দৌরাত্ম্য বাড়ছে।
কেদাহ পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন,
“মানবপাচারকারীরা নতুন রুট ব্যবহার করে ছোট ছোট নৌকা দিয়ে মানুষ পাঠাচ্ছে। আমরা নিয়মিত অভিযান চালালেও পাচারকারীদের নেটওয়ার্ক জটিল ও বিস্তৃত।”
উদ্ধারকৃতদের অভিমত
উদ্ধার হওয়া যাত্রীদের প্রাথমিক তথ্য থেকে জানা গেছে, তারা রাতে সাগর পাড়ি দিচ্ছিল। নৌকাটি অত্যন্ত জরাজীর্ণ ছিল এবং অতিরিক্ত যাত্রী ওঠানোর কারণে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ভারসাম্য হারায়।
একজন উদ্ধারপ্রাপ্ত যাত্রী বলেন—
“তিন দিন ধরে সাগরে ভেসে ছিলাম। আমাদের সঙ্গীদের অনেককে সাগর গিলে নিয়েছে।”
অনেকের সঙ্গে থাকা পরিবার বা আত্মীয়আজও নিখোঁজ। তাদের খুঁজে পাওয়ার আশা ক্রমেই ক্ষীণ হয়ে আসছে।
মানবাধিকার সংগঠনের উদ্বেগ
মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এবং আঞ্চলিক অভিবাসী অধিকার সংগঠনগুলো ঘটনাটিকে “ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়” হিসেবে উল্লেখ করেছে। তারা মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ড সরকারকে মানবপাচার নেটওয়ার্ক ভেঙে দিতে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
অ্যামনেস্টির বিবৃতিতে বলা হয়—
“যতদিন অভিবাসীদের নিরাপদ ও বৈধ পথে শ্রমবাজারে প্রবেশের সুযোগ তৈরি না হবে, ততদিন তারা এমন বিপজ্জনক নৌযাত্রায় বাধ্য হবে।”
মালয়েশিয়া–থাইল্যান্ড সীমান্তে নৌকাডুবির এই ঘটনা আবারও প্রমাণ করেছে, সমুদ্রপথে অবৈধ অভিবাসন কতটা ঝুঁকিপূর্ণ এবং প্রাণঘাতী হতে পারে। বহু মানুষের জীবন এখনো নিখোঁজ অবস্থায় রয়েছে। উদ্ধার অভিযান শেষ না হওয়া পর্যন্ত প্রকৃত ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানা যাবে না। তবে মানবপাচার চক্র নিয়ন্ত্রণ এবং অভিবাসীদের জন্য নিরাপদ পথ নিশ্চিত না হলে এই ধরনের ট্র্যাজেডি ভবিষ্যতেও ঘটতেই থাকবে—এমনটাই বলছেন বিশেষজ্ঞরা।











সত্যের সন্ধানে আমরা — NRD News Media Limited