যুক্তরাষ্ট্রে নতুন করে পরমাণু অস্ত্রের পরীক্ষা চালানোর ইঙ্গিত দিয়েছেন সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তবে তিনি এ ব্যাপারে স্পষ্ট করে বলেননি, এটি কি সরাসরি বিস্ফোরণমূলক পরীক্ষা হবে কিনা— যা হলে ১৯৯২ সালের পর প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্র এমন পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে।
এই অস্পষ্ট মন্তব্যকে ঘিরে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেখা দিয়েছে তীব্র উদ্বেগ, বিভ্রান্তি ও কূটনৈতিক প্রতিক্রিয়া।
শুক্রবার ফ্লোরিডায় হ্যালোইন উৎসবে যোগ দিতে যাওয়ার পথে এয়ার ফোর্স ওয়ানে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে ট্রাম্প বলেন,
“আমি কিছু বলব না। খুব শিগগিরই জানতে পারবেন। আমরা কিছু পরীক্ষা করব, হ্যাঁ। অন্য দেশগুলো করছে— যদি তারা করে, আমরাও করব।”
তাঁর এই বক্তব্যে যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক নীতি নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে। বিশেষ করে ১৯৯২ সালে সর্বশেষ বিস্ফোরণমূলক পরীক্ষা বন্ধ করার পর থেকে ওয়াশিংটন কেবল “সিমুলেশন ও ভার্চুয়াল টেস্ট” চালিয়ে এসেছে।
পটভূমি: ১৯৯২ সালের পর যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান
১৯৯২ সালে জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশ প্রশাসনের সময় যুক্তরাষ্ট্র আনুষ্ঠানিকভাবে পারমাণবিক বিস্ফোরণ পরীক্ষা বন্ধ করে দেয়। পরবর্তীতে ক্লিনটন প্রশাসন ১৯৯৬ সালে কম্প্রিহেনসিভ নিউক্লিয়ার টেস্ট ব্যান ট্রিটি (CTBT) স্বাক্ষর করে, যদিও এখনো সেটি সিনেট দ্বারা অনুমোদিত হয়নি।
এরপর থেকে যুক্তরাষ্ট্র মূলত ল্যাবভিত্তিক ও কম্পিউটার-সিমুলেটেড পরীক্ষা চালিয়ে তার অস্ত্রভাণ্ডারের কার্যকারিতা যাচাই করে আসছে। ট্রাম্পের এই নতুন ইঙ্গিত তাই অনেকের কাছে আন্তর্জাতিক পরমাণু নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার প্রতি একধরনের চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিচ্ছে।
বিশ্বের প্রতিক্রিয়া: উদ্বেগ ও নিন্দা
ট্রাম্পের বক্তব্যের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ইরান, জাপান ও আন্তর্জাতিক পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে তীব্র প্রতিক্রিয়া আসে।
ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাঘচি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লেখেন—
“একজন পারমাণবিক শক্তিধর নেতা দাদাগিরি করছে, আবার শান্তিপূর্ণ ইরানি কর্মসূচিকে অপবাদ দিচ্ছে। এটি সম্পূর্ণ দায়িত্বজ্ঞানহীন।”
অন্যদিকে, জাপানে হিরোশিমা ও নাগাসাকির বোমা হামলার বেঁচে থাকা ব্যক্তিদের সংগঠন ‘নিহন হিদানকিও’ যুক্তরাষ্ট্রের টোকিও দূতাবাসে একটি লিখিত প্রতিবাদ পাঠিয়েছে। সংগঠনের বিবৃতিতে বলা হয়,
“এই নির্দেশ বিশ্বব্যাপী পারমাণবিক অস্ত্রবিহীন শান্তিপূর্ণ পৃথিবীর প্রচেষ্টার পরিপন্থি এবং সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য।”
রাশিয়ার পক্ষ থেকেও মন্তব্য এসেছে। মস্কোর প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র বলেছেন, “যদি যুক্তরাষ্ট্র বাস্তব বিস্ফোরণমূলক পরীক্ষা শুরু করে, তা হলে সেটি পারমাণবিক প্রতিযোগিতাকে নতুন মাত্রায় নিয়ে যাবে।”
রাশিয়া ও চীনের ভূমিকা
ট্রাম্পের ঘোষণার আগে রাশিয়া জানিয়েছিল, তারা সফলভাবে পরীক্ষা চালিয়েছে নতুন পারমাণবিক শক্তিচালিত ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র ‘বুরেভেস্তনিক’ এবং পারমাণবিক ক্ষমতাসম্পন্ন ডুবো ড্রোনের। বিশ্লেষকদের মতে, রাশিয়ার এই পদক্ষেপের পর যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়ায় ট্রাম্প এমন ইঙ্গিত দিয়েছেন, যা একধরনের “ক্ষমতার প্রদর্শন”।
চীনও সম্প্রতি নিজেদের পরমাণু সক্ষমতা জোরদারের ঘোষণা দিয়েছে, যদিও তারা কোনো বিস্ফোরণমূলক পরীক্ষা চালায়নি।
নতুন শীতল যুদ্ধের ইঙ্গিত?
বিশ্ব রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ট্রাম্পের এই মন্তব্য কেবল মার্কিন পারমাণবিক নীতিতে নয়, বরং বৈশ্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থায়ও বড় ধাক্কা দিতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্র যদি পুনরায় সরাসরি পারমাণবিক পরীক্ষা চালায়, তাহলে রাশিয়া, চীন, ভারত, পাকিস্তান ও উত্তর কোরিয়া— সবাই নিজেদের অস্ত্রভাণ্ডার বাড়ানোর দিকে যেতে পারে।
ওয়াশিংটনভিত্তিক থিঙ্কট্যাংক আর্মস কন্ট্রোল অ্যাসোসিয়েশন এক বিবৃতিতে জানিয়েছে,
“এই ধোঁয়াশাপূর্ণ নির্দেশ কেবল নতুন অস্ত্র প্রতিযোগিতাকে উস্কে দেবে। এটি বৈশ্বিক নিরাপত্তার জন্য এক বিপজ্জনক মোড়।”
ট্রাম্পের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট
৭৯ বছর বয়সী রিপাবলিকান নেতা ডোনাল্ড ট্রাম্প বর্তমানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দৌড়ে রয়েছেন। তাঁর এই ঘোষণাকে অনেকেই নির্বাচনী কৌশল হিসেবে দেখছেন— “জাতীয় নিরাপত্তা” ও “আমেরিকান শক্তি প্রদর্শন” বিষয়কে সামনে রেখে রক্ষণশীল ভোটারদের সমর্থন টানার প্রয়াস।
তবে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির বিশ্লেষকরা সতর্ক করেছেন— ট্রাম্পের এই অবস্থান যুক্তরাষ্ট্রকে আন্তর্জাতিক পরমাণু চুক্তির বাইরে ঠেলে দিতে পারে, যার দীর্ঘমেয়াদি ফল হবে “আন্তর্জাতিক বিচ্ছিন্নতা ও অস্ত্র প্রতিযোগিতা।”
১৯৯২ সালের পর প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্রে যদি বিস্ফোরণমূলক পারমাণবিক পরীক্ষা হয়, তাহলে তা বৈশ্বিক নিরস্ত্রীকরণ প্রক্রিয়ার জন্য এক ভয়াবহ ধাক্কা হয়ে দাঁড়াবে। এখন বিশ্ব অপেক্ষা করছে— ট্রাম্পের “পরীক্ষা” আসলে কতটা প্রতীকী, আর কতটা বাস্তব।











সত্যের সন্ধানে আমরা — NRD News Media Limited