ব্রিটেনের রাজা তৃতীয় চার্লস আজ শুক্রবার উইন্ডসরে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে এক সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছেন। রাশিয়ার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ইউক্রেনের চলমান প্রতিরোধযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে অনুষ্ঠিত এ বৈঠক দুই দেশের সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ করার পাশাপাশি ইউরোপে শান্তি প্রতিষ্ঠার আহ্বানকেও নতুন মাত্রা দিয়েছে।
লন্ডন থেকে প্রকাশিত আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা এএফপি জানিয়েছে, ইউরোপীয় নেতাদের সঙ্গে রাশিয়ার ওপর নতুন করে চাপ বাড়ানোর বিষয়ে এক উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে অংশ নেওয়ার আগে জেলেনস্কি উইন্ডসরের রাজপ্রাসাদে রাজা তৃতীয় চার্লসের সঙ্গে দেখা করেন। এটি ছিল চলতি বছরে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ব্রিটিশ রাজার তৃতীয় সাক্ষাৎ।
রাজকীয় অভ্যর্থনা ও প্রতীকী সংহতি
সাক্ষাতের সময় ৭৬ বছর বয়সী রাজা তৃতীয় চার্লস ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টকে রাজকীয় অভিবাদন জানান। উইন্ডসর ক্যাসেলের অভ্যন্তরে রাজা ও জেলেনস্কির আগমনের সময় বাজানো হয় ইউক্রেনের জাতীয় সংগীত। প্রাসাদে উড়ানো হয় ইউক্রেনের পতাকাও— যা ব্রিটেনের পক্ষ থেকে ইউক্রেনের প্রতি এক দৃঢ় সংহতির বার্তা হিসেবে দেখা হচ্ছে।
বৈঠকের বিস্তারিত আলোচনা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা না হলেও রাজকীয় সূত্রের বরাতে ব্রিটিশ গণমাধ্যমগুলো জানায়, দুই নেতা ইউক্রেনের বর্তমান পরিস্থিতি, মানবিক সংকট এবং পুনর্গঠন প্রক্রিয়া নিয়ে কথা বলেছেন। রাজা চার্লস ইউক্রেনের জনগণের সাহসিকতা ও স্থিতিস্থাপকতার প্রশংসা করেন এবং বলেন, “আপনাদের জাতি ইতিহাসের এক কঠিন সময় অতিক্রম করছে, কিন্তু সাহস ও ঐক্যের মাধ্যমে আপনারা গণতন্ত্রের মূল্য রক্ষা করছেন।”
রাজনৈতিক বৈঠকের আগে কূটনৈতিক গুরুত্ব
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি বর্তমানে ইউরোপীয় দেশগুলোর নেতাদের সঙ্গে কূটনৈতিক সফরে রয়েছেন। শুক্রবার বিকেলে তিনি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারের সঙ্গে ডাউনিং স্ট্রিটে বৈঠক করবেন বলে লন্ডনভিত্তিক সংবাদমাধ্যমগুলো জানিয়েছে।
এই সফরের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো— ইউক্রেনের জন্য সামরিক সহায়তা, বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের বিষয়ে নতুন চুক্তি চূড়ান্ত করা। জানা গেছে, ব্রিটিশ সরকার ইউক্রেনকে আরও দীর্ঘমেয়াদি সামরিক সহায়তা দিতে প্রস্তুত রয়েছে, বিশেষ করে রাশিয়ার ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা প্রতিহত করতে।
রাজা চার্লসের সঙ্গে জেলেনস্কির সাক্ষাৎকে তাই শুধু সৌজন্যমূলক নয়, বরং প্রতীকী কূটনৈতিক বার্তা হিসেবে দেখা হচ্ছে। ইউরোপে ইউক্রেনের সমর্থনে ব্রিটেনের অবস্থান দৃঢ় করতে এই বৈঠক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে বিশ্লেষকদের মত।
উইন্ডসরের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
উইন্ডসর ক্যাসেল ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের প্রতীক ও রাজপরিবারের ঐতিহাসিক আবাস। এখানে বিশ্বনেতাদের সঙ্গে রাজপরিবারের সাক্ষাৎ সাধারণত হয় দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক জোরদারের উদ্দেশ্যে। এর আগে ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে জেলেনস্কি লন্ডন সফরে এসে রাজা চার্লসের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ করেন। পরবর্তীতে গত জুনে যুক্তরাজ্যে অনুষ্ঠিত একটি আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে তাদের দ্বিতীয়বার দেখা হয়।
রাজা চার্লস দীর্ঘদিন ধরে ইউক্রেনের যুদ্ধবিধ্বস্ত নাগরিকদের মানবিক সহায়তার বিষয়ে প্রকাশ্যে সমর্থন জানিয়ে আসছেন। তিনি যুদ্ধের শুরুতে বলেন, “ইউক্রেনের মানুষ শুধু তাদের মাতৃভূমির জন্য নয়, মানবিক মর্যাদা ও স্বাধীনতার জন্য লড়ছে।”
রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপট
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া ইউক্রেনে পূর্ণমাত্রার আক্রমণ শুরু করার পর থেকেই ইউরোপে ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা তীব্র আকার ধারণ করে। ব্রিটেন শুরু থেকেই ইউক্রেনের অন্যতম দৃঢ় সমর্থক দেশ হিসেবে ভূমিকা রাখছে। দেশটি কিয়েভকে উন্নত অস্ত্র, প্রশিক্ষণ ও আর্থিক সহায়তা দিয়ে আসছে।
বর্তমানে ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে যুদ্ধের তীব্রতা কমলেও রাশিয়ার বিমান হামলা ও ড্রোন আক্রমণ অব্যাহত রয়েছে। জেলেনস্কি তার সফরে পশ্চিমা দেশগুলোর কাছ থেকে নতুন করে আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ও পুনর্গঠনের জন্য অর্থ সহায়তা চাচ্ছেন।
বৈঠকের তাৎপর্য
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজা চার্লস ও জেলেনস্কির এই বৈঠকটি ইউক্রেন–ব্রিটেন সম্পর্কের ধারাবাহিকতা ও ইউরোপীয় ঐক্যের প্রতীক। এটি একদিকে ব্রিটিশ জনগণের সমর্থনকে আরও সুদৃঢ় করবে, অন্যদিকে রাশিয়ার প্রতি একটি কূটনৈতিক বার্তা পাঠাবে যে, ইউক্রেন একা নয়।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ ড. ম্যাথিউ জেনসন বলেন, “জেলেনস্কি এখন শুধু সামরিক সহায়তা নয়, কূটনৈতিক বৈধতা ও নৈতিক সমর্থনও চাইছেন। রাজা চার্লসের সঙ্গে এই সাক্ষাৎ সেই সমর্থনের প্রতীক।”
রাজা তৃতীয় চার্লসের সঙ্গে জেলেনস্কির এ সাক্ষাৎ প্রমাণ করে যে, ইউক্রেনের পাশে ব্রিটেন এখনো অবিচল রয়েছে। রাশিয়ার আগ্রাসন চলাকালীন সময়ে এই বৈঠক কেবল সৌজন্যমূলক নয়, বরং পশ্চিমা ঐক্যের বার্তা বহন করছে— ইউরোপ ও ব্রিটেন মানবিকতা, গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার পক্ষে এক কণ্ঠে দাঁড়িয়ে আছে।











সত্যের সন্ধানে আমরা — NRD News Media Limited