বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার ভারতের সঙ্গে সম্পাদিত একটি চুক্তি আনুষ্ঠানিকভাবে বাতিল করেছে, এবং আরও কয়েকটি বড় প্রকল্প বর্তমানে পুনর্মূল্যায়নের পর্যায়ে রয়েছে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন। মঙ্গলবার বিকেলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আয়োজিত এক ব্রিফিংয়ে তিনি এ তথ্য জানান।
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, “এখন পর্যন্ত শুধু একটি চুক্তিই বাতিল করা হয়েছে— সেটি হলো টাগবোট কেনার চুক্তি। প্রকল্পটি বাংলাদেশের জন্য আর্থিকভাবে লাভজনক নয় বলে পর্যালোচনায় দেখা গেছে। বিষয়টি নিয়ে ভারতীয় পক্ষের সঙ্গে আমাদের পারস্পরিক বোঝাপড়ার মাধ্যমেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।”
আদানি বিদ্যুৎ চুক্তি ও এলওসি প্রকল্পে পুনর্মূল্যায়ন
তৌহিদ হোসেন জানান, বর্তমানে বাংলাদেশ সরকার ভারতের সঙ্গে স্বাক্ষরিত আদানি বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি এবং লাইন অব ক্রেডিট (এলওসি)–এর আওতায় বাস্তবায়িত কিছু প্রকল্প পুনর্বিবেচনা করছে।
তার ভাষায়, “কিছু প্রকল্প বাংলাদেশের দৃষ্টিকোণ থেকে বাস্তবসম্মত বা অর্থনৈতিকভাবে তেমন সুবিধাজনক নয়। এসব কারণেই আমরা সেগুলো পুনর্মূল্যায়নের আওতায় এনেছি। পুনর্মূল্যায়নের পরই সিদ্ধান্ত হবে—কোন প্রকল্প চালু থাকবে, কোনটি বাতিল হবে।”
তিনি আরও বলেন, “আমাদের লক্ষ্য হলো— রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক স্বার্থ ও জনকল্যাণ নিশ্চিত করা। কোনো চুক্তিই বাতিল করা হচ্ছে না রাজনৈতিক কারণে, বরং দেশের দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থ বিবেচনা করেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে।”
শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণ ও ত্রিপুরা হত্যাকাণ্ড প্রসঙ্গে
ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণ বিষয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, “ভারতের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো আপডেট আমরা পাইনি।”
সম্প্রতি ভারতের ত্রিপুরায় তিন বাংলাদেশি নাগরিক হত্যার ঘটনায় বাংলাদেশের পাঠানো প্রতিবাদের জবাবও এখনো পাওয়া যায়নি বলে জানান তিনি।
তৌহিদ হোসেন বলেন, “আমরা ভারতের বক্তব্য গ্রহণ করিনি, কারণ এটি স্পষ্টতই দুই দেশের আইনে নিষিদ্ধ কাজ। আমরা এ ঘটনায় বিচার দাবি করেছি। আশা করি, ভারত আইন অনুযায়ী যথাযথ ব্যবস্থা নেবে।”
পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্গঠনের ইঙ্গিত
ব্রিফিংয়ে পাকিস্তানের অর্থমন্ত্রীর আসন্ন ঢাকা সফর নিয়েও কথা বলেন তৌহিদ হোসেন। তিনি বলেন, “বাংলাদেশ পাকিস্তানের সঙ্গে স্বাভাবিক দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক পুনর্গঠনে আগ্রহী। অর্থনৈতিক সহযোগিতা এবং আঞ্চলিক বাণিজ্য সম্প্রসারণের লক্ষ্যেই এই সফরটি গুরুত্বপূর্ণ।”
তিনি আরও যোগ করেন, “আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে এই সম্পর্কগুলো ইচ্ছাকৃতভাবে সীমিত করা হয়েছিল। কিন্তু আমরা এখন পারস্পরিক স্বার্থ ও অর্থনৈতিক বাস্তবতা বিবেচনায় এগোচ্ছি। পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক পুনরুদ্ধার বাংলাদেশের জন্য নতুন সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে।”
জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বিষয়ে স্পষ্টতা
জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মিশনে বাংলাদেশের সদস্য সংখ্যা হ্রাসের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্ত প্রসঙ্গে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, “এটি জাতিসংঘের কোনো বিশেষ দেশের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজেট সংকোচনের কারণেই এই হ্রাস করা হয়েছে।”
তিনি পরিষ্কারভাবে বলেন, “বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের প্রত্যাবাসনের বিষয়ে জাতিসংঘ ঢাকাকে অবহিত করেনি — এমন অভিযোগ সঠিক নয়। আমরা নিয়মিত জাতিসংঘের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি, যাতে আমাদের শান্তিরক্ষী সংখ্যা আনুপাতিক মাত্রার নিচে না নামে।”
কূটনৈতিক পুনর্গঠন ও নতুন দিকনির্দেশনা
ব্রিফিংয়ের শেষ পর্যায়ে তৌহিদ হোসেন বলেন, “বর্তমান সরকার বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিকে ‘সমতা ও স্বার্থকেন্দ্রিক’ ভিত্তিতে পুনর্গঠন করতে চায়। আমরা কোনো দেশের বিরোধিতা করছি না, আবার অন্ধ অনুসরণও করছি না।”
তিনি আরও যোগ করেন, “বাংলাদেশ সব প্রতিবেশীর সঙ্গে পারস্পরিক সম্মান ও স্বার্থের ভিত্তিতে কাজ করতে চায়। বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা বাড়াতে আমরা সক্রিয় ভূমিকা রাখব।”
নতুন কূটনৈতিক ভারসাম্যের ইঙ্গিত
পররাষ্ট্র বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের এই অবস্থান বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে নতুন এক ভারসাম্যের সূচনা করছে। ভারতের সঙ্গে দীর্ঘদিনের একপাক্ষিক অর্থনৈতিক সম্পর্ক পুনর্মূল্যায়ন এবং পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্গঠনের উদ্যোগ— উভয়ই একটি “স্বাধীন ও স্বার্থনির্ভর কূটনীতি”–র দিকে অগ্রগতির ইঙ্গিত দিচ্ছে।
