গাজা উপত্যকায় যুদ্ধবিরতির পরও থামেনি ইসরায়েলি হামলা। সরকারি সূত্রে জানা গেছে, ১০ অক্টোবর থেকে কার্যকর হওয়া যুদ্ধবিরতির পর গত এক সপ্তাহে অন্তত ৯৭ জন ফিলিস্তিনি নিহত এবং শতাধিক আহত হয়েছেন। গাজার সরকারি গণমাধ্যম কার্যালয় জানিয়েছে, ইসরায়েলি বাহিনী যুদ্ধবিরতির শর্ত ৮০ বার লঙ্ঘন করেছে, যা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ও মানবিক আইনের গুরুতর অবমাননা।
যুদ্ধবিরতির মধ্যেই হামলা
গাজার গণমাধ্যম কার্যালয় এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, “ইসরায়েলি দখলদার বাহিনী যুদ্ধবিরতির ঘোষণা উপেক্ষা করে বারবার বিমান ও গোলাবর্ষণ চালিয়েছে। এসব হামলায় নারী, শিশু এবং বৃদ্ধসহ বহু বেসামরিক নাগরিক হতাহত হয়েছেন।”
বিবৃতিতে বলা হয়, যুদ্ধবিরতির পর থেকে নথিভুক্ত ৮০টি লঙ্ঘনের মধ্যে রয়েছে—
- বেসামরিক মানুষের ওপর সরাসরি গুলি চালানো,
- ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় ইচ্ছাকৃত গোলাবর্ষণ,
- লক্ষ্যভিত্তিক বিমান হামলা,
- এবং একাধিক বেসামরিক নাগরিককে গ্রেপ্তার।
এছাড়া, কিছু এলাকায় চিকিৎসা দল ও সাংবাদিকদের লক্ষ্য করেও হামলার অভিযোগ উঠেছে।
আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ
গাজার প্রশাসন বলছে, এসব হামলা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন এবং জেনেভা কনভেনশন লঙ্ঘনের সামিল। কার্যালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়, “এই আচরণ দখলদার বাহিনীর আগ্রাসী মনোভাবের প্রতিফলন, যা মাটিতে উত্তেজনা বাড়ানোর স্পষ্ট ইঙ্গিত। তাদের রক্ত ও হত্যার প্রতি অবিরাম আসক্তি বিশ্বের সামনে আবারও প্রমাণিত হলো।”
গাজার তথ্যমন্ত্রী ইউসুফ আল-মাদহুন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, “যুদ্ধবিরতি মানা শুধু একটি রাজনৈতিক ঘোষণা নয়; এটি মানবজীবন রক্ষার প্রতিশ্রুতি। কিন্তু ইসরায়েল বারবার সেই প্রতিশ্রুতি পদদলিত করছে।”
হাসপাতাল ও স্কুলে হামলার অভিযোগ
স্থানীয় সূত্রের বরাত দিয়ে আরবি নিউজ চ্যানেল আল-কুদস জানায়, সম্প্রতি গাজার খান ইউনুস, রাফাহ ও দেইর আল-বালাহ এলাকায় ইসরায়েলি ড্রোন ও ট্যাংক হামলায় কয়েকটি হাসপাতাল, স্কুল ও শরণার্থী শিবির ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব স্থানে আশ্রয় নেওয়া শত শত মানুষ আতঙ্কে ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে।
চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, আহতদের মধ্যে অনেকের অবস্থা আশঙ্কাজনক। বিদ্যুৎ ঘাটতি ও ওষুধের সংকটের কারণে হাসপাতালগুলোতে স্বাভাবিক চিকিৎসা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে।
মানবাধিকার সংস্থাগুলোর নিন্দা
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এবং হিউম্যান রাইটস ওয়াচ উভয়ই যুদ্ধবিরতির পরও ইসরায়েলি হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। সংস্থাগুলো বলছে, “বেসামরিক এলাকায় নির্বিচারে হামলা আন্তর্জাতিক আইনে যুদ্ধাপরাধ হিসেবে গণ্য হতে পারে।”
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার ভলকার টুর্ক এক বিবৃতিতে বলেন, “গাজায় নিরপরাধ মানুষের মৃত্যু কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। আমরা অবিলম্বে নিরপেক্ষ তদন্ত ও যুদ্ধবিরতি পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থার জোরদার আহ্বান জানাই।”
ইসরায়েলের বক্তব্য
অন্যদিকে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী দাবি করেছে, তারা শুধুমাত্র ‘হামাসের সামরিক লক্ষ্যবস্তু’তে হামলা চালাচ্ছে এবং বেসামরিকদের ক্ষয়ক্ষতি ‘দুঃখজনক দুর্ঘটনা’। তবে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, গাজার ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাগুলোতে নিয়মিত বিমান হামলা চালানো কোনোভাবেই যুদ্ধবিরতির চেতনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
নতুন করে উদ্বেগ বাড়ছে
গাজার নাগরিকরা বলছেন, যুদ্ধবিরতির ঘোষণা কেবল কাগজে-কলমেই আছে; বাস্তবে বোমা ও গোলাগুলির শব্দ প্রতিদিনই তাদের ঘুম কেড়ে নিচ্ছে। শিশুদের মধ্যে আতঙ্ক ও মানসিক অস্থিরতা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে।
ফিলিস্তিনি বিশ্লেষক রামি হামদান বলেন, “যুদ্ধবিরতির পরও এমন হামলা চলতে থাকলে পুরো অঞ্চল আবারও পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে পারে। ইসরায়েলের আগ্রাসী নীতি ও আন্তর্জাতিক নীরবতা মিলে গাজাকে এক অমানবিক কারাগারে পরিণত করেছে।”
শান্তির আহ্বান
আন্তর্জাতিক মহল এখন নতুন করে যুদ্ধবিরতি পর্যবেক্ষণের জন্য স্বতন্ত্র কমিশন গঠনের দাবি তুলছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, তুরস্ক, কাতার ও মিসর ইতোমধ্যে গাজায় সহিংসতা বন্ধে মধ্যস্থতার প্রস্তাব দিয়েছে।
তবে যুদ্ধবিরতির বাস্তবায়ন কতটা সম্ভব হবে, তা এখনো অনিশ্চিত। গাজার মানুষের কাছে একটাই প্রত্যাশা—“আসল শান্তি, কাগজের শান্তি নয়।”
