বিধ্বস্ত গাজা উপত্যকার মানবিক পরিস্থিতি সরেজমিনে পর্যালোচনা করে জাতিসংঘের সাহায্য কার্যক্রমের প্রধান টম ফ্লেচার বলেছেন, এখানে সামনে রয়েছে “এক বিশাল, জটিল ও মানবিক পুনর্গঠনের কাজ”।
শনিবার (১৮ অক্টোবর) গাজা শহরের উত্তরাঞ্চলের শেখ রাদওয়ান এলাকায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত বসতবাড়ি ও একটি ক্ষতিগ্রস্ত বর্জ্যপানি শোধনাগার পরিদর্শনকালে তিনি এই মন্তব্য করেন।
জেরুজালেম থেকে প্রকাশিত আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা এএফপির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জাতিসংঘের সাদা জিপের একটি ছোট বহর নিয়ে ফ্লেচার ও তার সহকর্মীরা ধ্বংসস্তূপের ভেতর দিয়ে এগিয়ে যান। বোমায় বিধ্বস্ত বাড়িঘর, পুড়ে যাওয়া রাস্তাঘাট আর ভাঙা পানির লাইন— সবই যেন এক অবর্ণনীয় মানবিক ট্র্যাজেডির সাক্ষী।
‘একসময় দাঁড়িয়ে থাকা ভবন, এখন কেবল মরুভূমি’
ফ্লেচার বলেন, “মাত্র সাত-আট মাস আগেও আমি এই পথ দিয়ে গাড়ি চালিয়ে গিয়েছিলাম। তখন এই ভবনগুলোর অধিকাংশই অক্ষত ছিল। আজ দেখছি, পুরো এলাকা যেন এক বিরান মরুভূমি। এটি শুধু ধ্বংস নয়, এটি মানবতার এক গভীর ক্ষত।”
গত দুই বছরে হামাস ও ইসরাইলি বাহিনীর সংঘর্ষে গাজার ঘনবসতিপূর্ণ শহরগুলো প্রায় সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে। ঘরবাড়ি, হাসপাতাল, স্কুল, সড়ক—সবই পরিণত হয়েছে ধ্বংসস্তূপে। খাদ্য, জ্বালানি ও ওষুধের তীব্র সংকটের কারণে এখানকার প্রায় ২০ লাখ মানুষ এখন নিত্যদিনের জীবনযুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে।
মানবিক সহায়তার প্রবাহে ধীরগতি, রাফা সীমান্ত এখনো বন্ধ
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতি ঘোষণার এক সপ্তাহেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও মিশর ও গাজার মধ্যকার রাফা সীমান্ত এখনো খোলা হয়নি। ফলে মানবিক সহায়তার প্রবাহ ব্যাহত হচ্ছে।
তবে ইসরাইলি চেকপয়েন্ট দিয়ে প্রতিদিন কয়েক শত ট্রাক গাজায় প্রবেশ করছে, যা জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে খাদ্য ও চিকিৎসাসামগ্রী সরবরাহে ব্যবহৃত হচ্ছে। বৃহস্পতিবারই প্রায় ৯৫০টি ট্রাক গাজায় প্রবেশ করেছে বলে জাতিসংঘের মানবিক কার্যালয়ের (OCHA) পরিসংখ্যানে উল্লেখ রয়েছে।
‘মানুষ এখন মর্যাদা চায়’
শেখ রাদওয়ান এলাকার বর্জ্যপানি শোধনাগার পরিদর্শনের সময় ফ্লেচার বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত পাম্পিং সরঞ্জাম ও নষ্ট স্যানিটেশন ব্যবস্থার কারণে পুরো এলাকাই এখন জনস্বাস্থ্য ঝুঁকিতে।
তিনি বলেন, “আমি এমন অনেক বাসিন্দার সঙ্গে দেখা করেছি যারা নিজেদের বাড়ির ধ্বংসস্তূপের মধ্যে ল্যাট্রিন খনন করছে। তারা আমাকে বলেছে—তাদের সবচেয়ে বড় চাওয়া হলো কিছুটা মর্যাদা নিয়ে বাঁচা।”
ফ্লেচার আরও বলেন, “আমাদের প্রথম কাজ হবে বিদ্যুৎ সরবরাহ পুনরায় সচল করা, যাতে পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা চালু করা যায়। এরপর স্বাস্থ্যসেবা ও খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থা পুনর্গঠন শুরু করতে হবে।”
৬০ দিনের জরুরি পরিকল্পনা
জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা বিভাগ ইতোমধ্যে গাজার পুনর্বাসন ও জরুরি ত্রাণ কার্যক্রমের জন্য একটি ৬০ দিনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এই পরিকল্পনার আওতায় প্রতিদিন প্রায় ১০ লাখ মানুষের মধ্যে খাবার বিতরণ, হাসপাতাল পুনর্গঠন, শীতকালীন তাঁবু সরবরাহ এবং লাখো শিশুকে স্কুলে ফেরানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
ফ্লেচার বলেন, “এটি হবে বিশাল এক মানবিক প্রচেষ্টা। কিন্তু আমরা যদি দ্রুত কাজ শুরু না করি, তাহলে আসন্ন শীত গাজার মানুষের জন্য আরও ভয়াবহ হতে পারে।”
আন্তর্জাতিক আহ্বান
জাতিসংঘ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংস্থা মিশর সরকারকে দ্রুত রাফা সীমান্ত খুলে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। একই সঙ্গে তুরস্ক সীমান্তে অপেক্ষমাণ উদ্ধারকর্মীরা গাজার ধ্বংসস্তূপে আটকে থাকা মৃতদেহ উদ্ধারেও সহযোগিতা করতে চায় বলে জানিয়েছে।
গাজা আজ কেবল একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকা নয়; এটি মানবতার এক গভীর সংকটের প্রতীক। টম ফ্লেচারের ভাষায়, “এখানকার মানুষ এখন শুধু বাঁচতে নয়, মর্যাদার সঙ্গে বাঁচতে চায়—আর সেটিই আমাদের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব।”
