ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য ত্রিপুরায় সীমান্ত সংলগ্ন এলাকায় তিন বাংলাদেশি নাগরিককে পিটিয়ে হত্যার ঘটনাকে ‘নিন্দনীয়, অমানবিক ও মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন’ বলে অভিহিত করেছে বাংলাদেশ সরকার। এ ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে ভারত সরকারের কাছে তাৎক্ষণিক ও নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি জানিয়েছে ঢাকা।
গত ১৫ অক্টোবর (মঙ্গলবার) ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের দক্ষিণাঞ্চলের একটি সীমান্ত এলাকায় স্থানীয় একদল উশৃঙ্খল জনতা চোর সন্দেহে তিন বাংলাদেশিকে আটক করে বেধড়ক পেটায়। পরে হাসপাতালে নেওয়ার আগেই তারা নিহত হন বলে স্থানীয় গণমাধ্যমের বরাতে জানা যায়। নিহতদের পরিচয় তাৎক্ষণিকভাবে নিশ্চিত না হলেও তারা সীমান্তবর্তী বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার বাসিন্দা বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে।
শুক্রবার সকালে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দিয়ে এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের তীব্র নিন্দা জানায়। বিবৃতিতে বলা হয়,
“এটি মানবাধিকার ও আইনের শাসনের এক জঘন্য ও অগ্রহণযোগ্য লঙ্ঘন। বাংলাদেশ সরকার দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে, যে কোনো ব্যক্তিই—তার জাতীয়তা নির্বিশেষে—তার মৌলিক মানবাধিকার ও জীবনরক্ষার নিশ্চয়তা পাওয়ার অধিকারী। কেউ সীমান্তের যেদিকেই থাকুক না কেন, তাকে অমানবিকভাবে হত্যা করার কোনো অধিকার কারও নেই।”
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আরও জানায়, বাংলাদেশ সরকার ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখছে এবং এই ঘটনায় দোষীদের চিহ্নিত করে দ্রুত বিচারের আওতায় আনার আহ্বান জানিয়েছে। একই সঙ্গে এমন নৃশংস ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে ভারত সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, দুই দেশের সীমান্তে প্রায়ই এমন দুঃখজনক ঘটনা ঘটে, যা শুধু নিরীহ মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয় না, বরং দুই প্রতিবেশী দেশের ঐতিহ্যগত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কেও আঘাত হানে।
“বাংলাদেশ সরকার আশা করছে, ভারত সরকার আন্তরিকভাবে তদন্ত চালাবে এবং প্রকৃত অপরাধীদের বিচারের মুখোমুখি করবে—যাতে ভবিষ্যতে কোনো নিরপরাধ মানুষ এমন নির্মম পরিণতির শিকার না হন।”
ত্রিপুরার স্থানীয় সংবাদমাধ্যম ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোর তথ্য অনুযায়ী, ওই তিন বাংলাদেশি সীমান্ত পেরিয়ে স্থানীয় বাজারের কাছাকাছি এলাকায় প্রবেশ করলে কিছু লোক তাদের ঘিরে ধরে। পরে ‘চোর সন্দেহে’ গণপিটুনি শুরু হয়। তবে ঘটনার সঙ্গে কোনো সরকারি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জড়িত কি না, সে বিষয়ে এখনো নিশ্চিত তথ্য পাওয়া যায়নি।
ঘটনার পর ভারতের মানবাধিকার সংগঠনগুলোও এই হত্যার নিন্দা জানায়। তারা বলছে, ‘চোর সন্দেহে’ কাউকে আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে হত্যা করা ন্যায়ের চরম অবমাননা।
বাংলাদেশের মানবাধিকারকর্মীরাও ঘটনাটির কঠোর নিন্দা জানিয়েছেন। তারা মনে করেন, সীমান্ত এলাকায় বারবার এই ধরনের সহিংসতা বন্ধ করতে দুই দেশের প্রশাসনের আরও ঘনিষ্ঠ সমন্বয় জরুরি।
মানবাধিকার কর্মী ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ড. ফারহানা আক্তার বলেন,
“এ ধরনের ঘটনা শুধু সীমান্তের ভৌগোলিক সমস্যার ফল নয়; বরং এটি এক ধরনের মনোভাবগত ব্যর্থতা, যেখানে মানবজীবনের মূল্যকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয় না। দুই সরকারকেই এখনই কার্যকর যৌথ উদ্যোগ নিতে হবে।”
এর আগে, চলতি বছরের জানুয়ারিতেও মেঘালয়ে সীমান্ত পারাপারের সময় এক বাংলাদেশি যুবককে গুলি করে হত্যা করার অভিযোগ ওঠে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)-এর বিরুদ্ধে। এ নিয়ে ২০২৫ সালের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত সীমান্তে অন্তত ৭ জন বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন বলে বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের প্রতিবেদন জানায়।
বাংলাদেশ সরকার পুনরায় জোর দিয়ে বলেছে, সীমান্তে মানবিক আচরণ নিশ্চিত করা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষার নামে অপ্রয়োজনীয় বলপ্রয়োগ বন্ধে ভারত সরকারের সঙ্গে সমন্বিত পদক্ষেপ এখন সময়ের দাবি।
ঢাকা বলছে, এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি দুই দেশের সম্পর্কের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে—যা দীর্ঘদিনের বন্ধুত্বপূর্ণ পারস্পরিক আস্থা ও সহযোগিতাকে দুর্বল করবে।
