ইতালির রাজধানী রোমে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) সদর দপ্তরে অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড ফুড ফোরাম (World Food Forum – WFF) উপলক্ষে এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক করেছেন বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ও ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিও লুলা দা সিলভা। সোমবার স্থানীয় সময় দুপুরে অনুষ্ঠিত এই বৈঠকে দুই দেশের মধ্যে টেকসই কৃষি, খাদ্য নিরাপত্তা, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা উন্নয়ন এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় সহযোগিতার নানা দিক নিয়ে আলোচনা হয়।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, অধ্যাপক ইউনূস ও প্রেসিডেন্ট লুলা দা সিলভা বৈঠকে বৈশ্বিক খাদ্য সংকট মোকাবিলায় উন্নয়নশীল দেশগুলোর পারস্পরিক সহযোগিতার গুরুত্বের ওপর জোর দেন। তারা মনে করেন, বর্তমান পৃথিবীতে খাদ্য উৎপাদন ও বিতরণব্যবস্থায় বৈষম্য তৈরি হয়েছে, যা দারিদ্র্য ও ক্ষুধা সমস্যাকে আরও গভীর করছে।
বৈঠকে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, “বিশ্বের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলোর একটি হচ্ছে টেকসই খাদ্যব্যবস্থা গড়ে তোলা। আমরা যদি কৃষিকে মানুষের হাতে ফিরিয়ে দিতে পারি, তবে তা শুধু খাদ্যনিরাপত্তাই নয়, দারিদ্র্য হ্রাস ও সামাজিক ন্যায্যতাও নিশ্চিত করবে।”
তিনি আরও উল্লেখ করেন, বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতিতে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ও নারী কৃষকদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। ইউনূসের ভাষায়, “আমরা যে ‘সোশ্যাল বিজনেস’ মডেল তৈরি করেছি, তা এখন বিশ্বব্যাপী দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আত্মনির্ভরতার পথ খুলে দিচ্ছে।”
অন্যদিকে, প্রেসিডেন্ট লুলা দা সিলভা অধ্যাপক ইউনূসের উদ্যোগের প্রশংসা করে বলেন, “আমরা ব্রাজিলে সামাজিক ন্যায্যতা ও ক্ষুধামুক্ত সমাজ গড়ার লড়াই করছি। অধ্যাপক ইউনূসের কাজ আমাদের জন্য এক অনুপ্রেরণা। কৃষি, ক্ষুদ্রঋণ ও সামাজিক ব্যবসায় বাংলাদেশ থেকে শেখার অনেক কিছু আছে।”
বৈঠকে দুজন নেতাই একমত হন যে, উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে অভিজ্ঞতা বিনিময়, প্রযুক্তিগত সহায়তা ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা প্রশিক্ষণ কর্মসূচি জোরদার করলে বৈশ্বিক খাদ্যব্যবস্থায় একটি ইতিবাচক পরিবর্তন আনা সম্ভব।
এফএও ফোরামে বাংলাদেশের ভূমিকা
রোমে অনুষ্ঠিত এবারের ওয়ার্ল্ড ফুড ফোরামে টেকসই খাদ্যব্যবস্থা, কৃষি উদ্ভাবন ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার বিষয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান, মন্ত্রী ও বিশেষজ্ঞরা অংশ নিচ্ছেন। অধ্যাপক ইউনূস ফোরামের একটি বিশেষ সেশনেও বক্তব্য দেন, যেখানে তিনি ক্ষুদ্রঋণ ও সোশ্যাল বিজনেস মডেলের মাধ্যমে দারিদ্র্য ও ক্ষুধা দূরীকরণের বাস্তব অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, “খাদ্যকে পণ্য নয়, মানবাধিকারের অংশ হিসেবে দেখতে হবে। প্রতিটি মানুষ যেন নিজের খাদ্য উৎপাদনে ভূমিকা রাখতে পারে—এই ধারণার ওপর ভিত্তি করেই আমাদের নতুন কৃষি অর্থনীতি গড়ে তুলতে হবে।”
বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আরও জানানো হয়, অধ্যাপক ইউনূস এফএও ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে যৌথভাবে দক্ষিণ এশিয়ায় টেকসই কৃষি উদ্ভাবন প্রচারে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। বিশেষ করে, জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত উপকূলীয় অঞ্চলে বিকল্প কৃষি প্রযুক্তি উন্নয়ন, লবণসহিষ্ণু ফসল চাষ এবং নারী উদ্যোক্তাদের ক্ষমতায়নের দিকটি অগ্রাধিকার পাচ্ছে।
বৈঠকের তাৎপর্য
বিশ্লেষকদের মতে, ব্রাজিল ও বাংলাদেশের মধ্যে এই উচ্চপর্যায়ের বৈঠক ভবিষ্যতে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে নতুন মাত্রা দিতে পারে। বিশেষ করে ব্রাজিলের উন্নত কৃষি প্রযুক্তি ও বাংলাদেশের সামাজিক ব্যবসা মডেল—দুই দেশের অভিজ্ঞতা একত্রিত হলে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (SDGs) অর্জনে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সম্ভব হবে।
এফএও সদর দপ্তরের করিডোরে আয়োজিত এই সংক্ষিপ্ত কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ বৈঠকটি আন্তর্জাতিক মহলেও ইতিবাচক সাড়া ফেলেছে। উন্নয়ন অর্থনীতিতে নোবেলজয়ী অধ্যাপক ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক শেষে প্রেসিডেন্ট লুলা সামাজিক মাধ্যমে লেখেন, “বিশ্বে ক্ষুধা ও দারিদ্র্য নির্মূলে একসঙ্গে কাজ করার এটাই সময়।”
