অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার ২০২৫ পেলেন তিন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ—ইসরায়েলি বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক জোয়েল মকিয়র, ফ্রান্সের ফিলিপ আগিয়োঁ এবং কানাডার পিটার হাউইট।
তাদের গবেষণা আধুনিক অর্থনৈতিক তত্ত্বে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি এনে দিয়েছে, বিশেষ করে প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন ও সৃজনশীল বিনাশের মাধ্যমে টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির তত্ত্ব প্রতিষ্ঠায়।
সোমবার (১৩ অক্টোবর) সুইডেনের রয়েল সুইডিশ একাডেমি অব সায়েন্সেস স্টকহোমে এক সংবাদ সম্মেলনে এবারের অর্থনীতিতে নোবেল বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করে।
প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন কীভাবে বদলে দেয় অর্থনীতির গতিপথ
নোবেল কমিটির বিবৃতিতে বলা হয়েছে,
“প্রযুক্তিগত অগ্রগতির মাধ্যমে টেকসই প্রবৃদ্ধির পূর্বশর্তগুলো নির্ধারণে অবদানের জন্য”
জোয়েল মকিয়র পুরস্কারের অর্ধেক পেয়েছেন।
আর বাকি অর্ধেক ভাগাভাগি করেছেন ফিলিপ আগিয়োঁ ও পিটার হাউইট, যারা একসঙ্গে ‘সৃজনশীল বিনাশের মাধ্যমে টেকসই প্রবৃদ্ধির তত্ত্ব’ উপস্থাপন করেছেন।
অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার কমিটির চেয়ারম্যান জন হাসলার সাংবাদিকদের বলেন,
“এই তিন গবেষক আমাদের দেখিয়েছেন, প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন শুধু প্রবৃদ্ধির ইঞ্জিন নয়, বরং তা সমাজ ও বাজারকে পুনর্গঠিত করে টেকসই অগ্রগতির ভিত্তি তৈরি করে।”
‘ঐতিহাসিক অর্থনীতির স্থপতি’ জোয়েল মকিয়র
যুক্তরাষ্ট্রের নর্থওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জোয়েল মকিয়র দীর্ঘদিন ধরে অর্থনৈতিক ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করছেন। তিনি ঐতিহাসিক সূত্র ও পরিসংখ্যান ব্যবহার করে দেখিয়েছেন, কীভাবে ১৮শ শতাব্দীর শিল্পবিপ্লবের সময় থেকে প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির চালিকাশক্তিতে পরিণত হয়েছে।
মকিয়রের মতে, অর্থনৈতিক উন্নয়নের মূলে রয়েছে জ্ঞানভিত্তিক উদ্ভাবন ও প্রযুক্তিগত মানোন্নয়ন। তিনি তাঁর বই “The Lever of Riches” এবং “A Culture of Growth”-এ দেখিয়েছেন, সমাজে বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী চিন্তার প্রসারই ইউরোপীয় অর্থনৈতিক বিপ্লবের মূল কারণ ছিল।
সৃজনশীল বিনাশ: নতুন ও পুরোনোর সংঘাতে অগ্রগতি
অন্যদিকে ফিলিপ আগিয়োঁ ও পিটার হাউইট যৌথভাবে অর্থনীতিতে ‘সৃজনশীল বিনাশ (Creative Destruction)’ ধারণাটিকে আধুনিক তাত্ত্বিক কাঠামো হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন।
এই তত্ত্ব মূলত অর্থনীতিবিদ জোসেফ শুমপিটার-এর ধারণার আধুনিক রূপ। এর মাধ্যমে বোঝানো হয়—যখন নতুন ও উন্নত কোনো প্রযুক্তি বা পণ্য বাজারে আসে, তখন পুরনো প্রতিষ্ঠানগুলো টিকে থাকতে পারে না। তবে এই ধ্বংসই অর্থনীতিতে নতুন সুযোগ সৃষ্টি করে।
নোবেল কমিটি তাদের অবদানের ব্যাখ্যা দিয়ে জানায়,
“তারা ব্যাখ্যা করেছেন, কীভাবে উদ্ভাবন ও প্রতিযোগিতার মধ্যকার ভারসাম্য বজায় রেখে দীর্ঘমেয়াদি প্রবৃদ্ধি সম্ভব হয়।”
আগিয়োঁ–হাউইটের গবেষণা আজকের ডিজিটাল অর্থনীতি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও সবুজ জ্বালানির যুগে বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে, যেখানে প্রতিনিয়ত পুরোনো প্রযুক্তির জায়গা নিচ্ছে নতুন উদ্ভাবন।
অর্থনীতিতে নোবেল: ইতিহাস ও তাৎপর্য
অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার আলফ্রেড নোবেলের ১৮৯৬ সালের উইলে উল্লেখিত মূল পাঁচটি পুরস্কারের (শান্তি, সাহিত্য, পদার্থ, রসায়ন ও চিকিৎসা) অংশ নয়।
১৯৬৮ সালে সুইডিশ কেন্দ্রীয় ব্যাংক Sveriges Riksbank আলফ্রেড নোবেলের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এই পুরস্কার চালু করে। এর আনুষ্ঠানিক নাম—
“The Sveriges Riksbank Prize in Economic Sciences in Memory of Alfred Nobel.”
তবে পুরস্কারের নির্বাচন ও প্রদানের দায়িত্ব রয়্যাল সুইডিশ একাডেমি অব সায়েন্সেসের উপরই বর্তায়, ঠিক অন্যান্য নোবেল পুরস্কারের মতোই।
২০২৫ সালের নোবেল মৌসুমের সমাপ্তি
অর্থনীতিতে এই পুরস্কারের মাধ্যমে ২০২৫ সালের নোবেল মৌসুমের আনুষ্ঠানিক পরিসমাপ্তি ঘটলো।
চলতি বছর নোবেল কমিটি বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী গবেষণা ও অবদানের স্বীকৃতি দিয়েছে—
- চিকিৎসায়: মানবদেহের রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থার গভীরতর বোঝাপড়ার জন্য,
- পদার্থবিজ্ঞানে: কোয়ান্টাম মেকানিকসের ব্যবহারিক প্রয়োগে অগ্রগতির জন্য,
- রসায়নে: নতুন আণবিক গঠন প্রযুক্তির উদ্ভাবনের জন্য।
সাহিত্যে নোবেল পেয়েছেন হাঙ্গেরির লেখক লাসলো ক্রাস্নাহোরকাই, যিনি উত্তর-আধুনিক যুগের হতাশা ও নৈরাশ্যকে সাহিত্যিক রূপ দিয়েছেন।
আর শান্তিতে নোবেল পেয়েছেন ভেনেজুয়েলার বিরোধীদলীয় নেতা মারিয়া কোরিনা মাচাদো, যিনি পুরস্কারটি উৎসর্গ করেছেন
“বিশ্বে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের জন্য সংগ্রামরত সকল মানুষের প্রতি।”
পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠান ও সম্মাননা
আগামী ১০ ডিসেম্বর, আলফ্রেড নোবেলের মৃত্যুবার্ষিকীতে, স্টকহোম ও অসলোতে একযোগে নোবেল পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হবে।
প্রত্যেক বিজয়ী পাবেন একটি স্বর্ণপদক, একটি সনদপত্র, এবং ১২ লাখ মার্কিন ডলারের পুরস্কার অর্থ।
যদি কোনো বিভাগে একাধিক বিজয়ী থাকেন, তবে পুরস্কারের অর্থ ভাগ করে দেওয়া হবে।
অর্থনীতিতে নোবেল বিজয়ীদের এই গবেষণা শুধু অর্থনীতির গতিপথই বদলে দিচ্ছে না, বরং দেখাচ্ছে—উদ্ভাবন, সৃজনশীলতা ও প্রতিযোগিতাই টেকসই উন্নয়নের প্রকৃত চালিকা শক্তি।
অর্থনীতিবিদ জন হাসলার যেমন বলেছেন,
“তাদের কাজ আমাদের মনে করিয়ে দেয়—অর্থনৈতিক অগ্রগতি কখনোই স্থির নয়, এটি এক অবিরাম উদ্ভাবনের যাত্রা।”
