বাংলাদেশ ও অস্ট্রেলিয়ার কূটনৈতিক সম্পর্ক আরও জোরদার করতে ঢাকায় আসছেন অস্ট্রেলিয়ার ক্ষুদ্র ব্যবসা, আন্তর্জাতিক উন্নয়ন ও বহুসংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রী ড. অ্যান অ্যালি। ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে অস্ট্রেলিয়ার কৌশলগত অংশীদারিত্ব শক্তিশালী করা এবং বাংলাদেশ ও ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক আরও গভীর করার লক্ষ্য নিয়েই তাঁর এই সরকারি সফর।
অস্ট্রেলিয়ার ঢাকাস্থ দূতাবাস সোমবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, সফরকালে ড. অ্যান অ্যালি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করবেন “অস্ট্রেলিয়া–বাংলাদেশ উন্নয়ন অংশীদারিত্ব পরিকল্পনা ২০২৫–২০৩০”। এই পরিকল্পনার মাধ্যমে বাংলাদেশের টেকসই, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং গণতান্ত্রিক উন্নয়নকে সমর্থন জানাবে ক্যানবেরা।
দূতাবাসের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, নতুন অংশীদারিত্ব কাঠামো ভবিষ্যৎ পাঁচ বছরের দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতার রূপরেখা নির্ধারণ করবে। এতে টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, মানব উন্নয়ন, জলবায়ু সহনশীলতা ও সামাজিক অন্তর্ভুক্তির মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলো অগ্রাধিকার পাবে।
অস্ট্রেলীয় মন্ত্রী এক বিবৃতিতে বলেছেন,
“বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে—অস্ট্রেলিয়া এই যাত্রাকে স্বাগত জানায় এবং দৃঢ়ভাবে পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে।”
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির অন্যতম উজ্জ্বল উদাহরণ, এবং অস্ট্রেলিয়া বিশ্বাস করে—দুই দেশের জনগণ-নির্ভর সম্পর্ক ভবিষ্যতে আরও বহুমাত্রিক হয়ে উঠবে।
রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে গুরুত্ব দিচ্ছে ক্যানবেরা
ঢাকায় অবস্থানকালে ড. অ্যান অ্যালি কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শন করবেন। সেখানে তিনি বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মানবিক পরিস্থিতি সরেজমিনে দেখবেন এবং বাংলাদেশের মানবিক অবদানের প্রশংসা করবেন বলে দূতাবাস জানিয়েছে।
রোহিঙ্গা সংকটকে তিনি অভিহিত করেছেন—
“এই অঞ্চলের সবচেয়ে বৃহৎ এবং জটিল মানবিক সংকট” হিসেবে।
এই প্রেক্ষাপটে অস্ট্রেলিয়া আগামী তিন বছরে বাংলাদেশে আশ্রিত মিয়ানমারের রোহিঙ্গা ও স্থানীয় ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর জন্য অতিরিক্ত ৩৭০ মিলিয়ন অস্ট্রেলিয়ান ডলার (প্রায় ২৪৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার) সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
২০১৭ সাল থেকে এখন পর্যন্ত রোহিঙ্গা ইস্যুতে অস্ট্রেলিয়ার মোট প্রতিশ্রুত অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১.২৬ বিলিয়ন অস্ট্রেলিয়ান ডলার—যা দেশটির পক্ষ থেকে দক্ষিণ এশিয়ায় অন্যতম বড় মানবিক সহায়তা উদ্যোগ।
অঞ্চলীয় স্থিতিশীলতা ও সহযোগিতায় নতুন দিগন্ত
অস্ট্রেলিয়ার সরকার সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে তাদের কৌশলগত ও অর্থনৈতিক সম্পৃক্ততা বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে। এই সফর সেই নীতিরই ধারাবাহিকতা।
বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান, জনসংখ্যাগত সুবিধা ও ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক সক্ষমতা অস্ট্রেলিয়ার কাছে এখন একটি সম্ভাবনাময় অংশীদারত্বের দ্বার উন্মোচন করছে। বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা, নবায়নযোগ্য জ্বালানি, শিক্ষা ও মানবসম্পদ উন্নয়ন খাতে সহযোগিতার নতুন সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, দক্ষিণ এশিয়ার স্থিতিশীলতা ও উন্নয়ন অস্ট্রেলিয়ার বৃহত্তর “ইন্ডো–প্যাসিফিক কৌশল”-এর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আর সেই কৌশলের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে বাংলাদেশ—যা একদিকে ভারতের প্রতিবেশী ও অন্যদিকে বঙ্গোপসাগরীয় অর্থনৈতিক অঞ্চলের একটি উদীয়মান শক্তি।
দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্কের ভিত্তি মজবুত করার বার্তা
অস্ট্রেলিয়া-বাংলাদেশ সম্পর্কের ৫০ বছরেরও বেশি ইতিহাসে এই সফরকে একটি নতুন মাইলফলক হিসেবে দেখা হচ্ছে। কূটনৈতিক মহল বলছে, এই সফরের মধ্য দিয়ে উন্নয়ন অংশীদারিত্ব ছাড়াও শিক্ষা, বাণিজ্য, নারীর ক্ষমতায়ন, ডিজিটাল উদ্ভাবন ও জলবায়ু অভিযোজন খাতে সহযোগিতা আরও সম্প্রসারিত হবে।
দূতাবাসের এক কর্মকর্তা জানান,
“বাংলাদেশ এখন দক্ষিণ এশিয়ার একটি অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছে। অস্ট্রেলিয়া চায় এই প্রবৃদ্ধি যেন টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক হয়—সেই লক্ষ্যে আমাদের পারস্পরিক সহযোগিতা আরও গভীর হবে।”
ড. অ্যান অ্যালির এই সফর তাই শুধু একটি কূটনৈতিক সফর নয়, বরং দুই দেশের মধ্যে উন্নয়ন, মানবিক সহায়তা ও জনগণের পারস্পরিক বোঝাপড়াকে আরও মজবুত করার একটি প্রতীকী পদক্ষেপ হিসেবেও বিবেচিত হচ্ছে।
