ইসরাইলি অবরোধ ভাঙার চেষ্টা করা মানবিক সহায়তা বহনকারী একটি নতুন নৌ-বহরকে আটক করেছে ইসরাইলি নৌবাহিনী। যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজার উদ্দেশে যাত্রা করা এই বহরটি গাজা উপকূল থেকে প্রায় ২২০ কিলোমিটার দূরে বাধা দেওয়া হয়। এতে থাকা শতাধিক মানবাধিকারকর্মী, চিকিৎসক ও সাংবাদিককে ইসরাইলি বাহিনী আটক করেছে বলে নিশ্চিত করেছে আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংস্থা গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা।
সংস্থাটির পক্ষ থেকে আজ (বুধবার) ভোরে জানানো হয়, প্রথমে তাদের তিনটি জাহাজে ইসরাইলি বাহিনী হামলা চালিয়ে সেটি দখল করে নেয়। পরবর্তীতে পুরো নৌ-বহরের ৯টি জাহাজই আটক করা হয়েছে। আটক হওয়া জাহাজগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘কনশানস’ নামের জাহাজ, যেখানে ছিলেন ৯০ জনেরও বেশি সাংবাদিক, চিকিৎসক ও মানবাধিকারকর্মী।
এ ঘটনার মাধ্যমে এক সপ্তাহের ব্যবধানে দ্বিতীয়বারের মতো গাজাগামী আন্তর্জাতিক ত্রাণবহরকে আটক করল ইসরাইল। এর আগে গত সপ্তাহে ‘হোপ ফর গাজা’ নামের আরেকটি ফ্লোটিলাকে আটক করে তাতে থাকা বেশ কয়েকজন আন্তর্জাতিক কর্মীকে জিজ্ঞাসাবাদ করে ইসরাইলি কর্তৃপক্ষ।
‘মানবিক বিপর্যয়কে আরও গভীর করছে ইসরাইল’
জাতিসংঘের হিসেবে, দুই বছর ধরে চলা ভয়াবহ সংঘাতে গাজায় এখন কার্যত দুর্ভিক্ষ শুরু হয়েছে। খাদ্য, ওষুধ, পানি ও জ্বালানির তীব্র সংকটে লাখ লাখ ফিলিস্তিনি অনাহারে দিন কাটাচ্ছেন। জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা সংস্থা (OCHA) জানিয়েছে, গাজায় সহায়তা পৌঁছানোর সব পথ প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে ইসরাইল।
গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা জানায়, তাদের লক্ষ্য ছিল গাজাবাসীর জন্য খাবার, ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম সরবরাহ করা। তবে ইসরাইলি বাহিনী আন্তর্জাতিক জলসীমায় তাদের ওপর আক্রমণ চালায়, যা আন্তর্জাতিক আইনের স্পষ্ট লঙ্ঘন বলে অভিযোগ করেছে সংস্থাটি। তারা জানিয়েছে, আটক হওয়া কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
নৌ-বহর আটকে দেওয়ার ঘটনায় বিশ্বজুড়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। নরওয়ে, আয়ারল্যান্ড, তুরস্ক, স্পেনসহ একাধিক ইউরোপীয় দেশ ইসরাইলের এই পদক্ষেপের নিন্দা জানিয়েছে। জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্টোনিও গুতেরেস এক বিবৃতিতে বলেন, “মানবিক ত্রাণবহর লক্ষ্য করে হামলা সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য। গাজার জনগণকে সহায়তা দেওয়া আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের অংশ।”
তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাকান ফিদান বলেছেন, “ইসরাইল ইচ্ছাকৃতভাবে গাজাকে একটি খোলা কারাগারে পরিণত করেছে। মানবিক সহায়তা আটকানো মানে যুদ্ধাপরাধ।”
অন্যদিকে ইসরাইলি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় দাবি করেছে, “নৌ-বহরটি অনুমতি ছাড়াই অবরুদ্ধ জলসীমায় প্রবেশের চেষ্টা করছিল। নিরাপত্তার স্বার্থে তাদের আটক করা হয়েছে।” তবে তারা কোনো সহিংসতার অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
গাজার পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ
গত দুই বছরে ইসরাইলের লাগাতার বোমাবর্ষণে গাজার অবকাঠামো প্রায় সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে। হাসপাতাল, স্কুল, পানি সরবরাহব্যবস্থা এবং আশ্রয়কেন্দ্রগুলোর অধিকাংশই অকেজো হয়ে পড়েছে। জাতিসংঘ জানিয়েছে, প্রায় ২৪ লাখ মানুষের মধ্যে অন্তত ৮০ শতাংশ এখন ত্রাণের ওপর নির্ভরশীল।
ইসরাইলের অবরোধ ও সামরিক অভিযান অব্যাহত থাকায় আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংস্থাগুলোর পক্ষে গাজায় সহায়তা পৌঁছানো ক্রমেই কঠিন হয়ে পড়ছে। সম্প্রতি মিশর ও জর্ডানের মধ্যস্থতায় সীমিত আকারে কিছু ত্রাণ ট্রাক গাজায় প্রবেশের অনুমতি পেলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অত্যন্ত অল্প।
বিশ্বব্যাপী সংহতি বাড়ছে
যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হওয়ায় ফিলিস্তিনের প্রতি বৈশ্বিক সংহতি দ্রুত বাড়ছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি, কানাডা ও জাপানের বিভিন্ন শহরে হাজার হাজার মানুষ ইসরাইলের নীতির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে #LetAidReachGaza হ্যাশট্যাগে চলছে বৈশ্বিক প্রচারণা।
মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলেছে, “গাজায় সহায়তা বন্ধ রাখা মানে ইচ্ছাকৃতভাবে মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া।”
ইসরাইলের নিন্দায় নিন্দার ঝড়
বিশ্লেষকদের মতে, নৌ-বহর আটকে দেওয়ার ঘটনা ইসরাইলের কূটনৈতিক অবস্থানকে আরও কঠিন করে তুলবে। বিশেষ করে পশ্চিমা বিশ্বে মানবিক সংস্থাগুলোর ওপর হামলা ইসরাইলের ভাবমূর্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
এদিকে ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন, “গাজায় মানবিক করিডর খুলে দিতে হবে অবিলম্বে। নতুবা মানবিক বিপর্যয় আরও ভয়াবহ আকার নেবে।”
