গাজা উপকূলে পৌঁছাতে চাওয়া ত্রাণবাহী আন্তর্জাতিক নৌবহর গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা ইসরাইলি নৌবাহিনীর বাধার মুখে পড়েছে। আক্রমণাত্মক পদক্ষেপ, ড্রোন হামলা, জাহাজে বোর্ডিং অভিযান এবং যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার মতো কৌশল নিয়েও আয়োজকরা জানিয়েছেন, তারা পিছু হটবেন না। মিশনের মূল লক্ষ্য—দীর্ঘদিনের নৌ-অবরোধ ভেঙে মানবিক সাহায্য সরাসরি গাজার সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া।
সংঘর্ষ ও বাধা
১ অক্টোবর একাধিক জাহাজের ক্যামেরা ও জিপিএস সিগন্যাল বিঘ্নিত হয়ে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়। অভিযোগ রয়েছে, ইসরাইলি বাহিনী অন্তত একটি ড্রোন হামলা চালিয়েছে এবং কয়েকটি জাহাজে বোর্ডিং অভিযান পরিচালনা করেছে। এর ফলে বেশ কয়েকজন কর্মীকে আটক করা হয়েছে। পাকিস্তানের দৈনিক ডন জানিয়েছে, নৌবহর কর্তৃপক্ষ এই আটককে ‘বেআইনী’ বলছে।
এপি জানিয়েছে, গাজা থেকে প্রায় ৭০ নটিক্যাল মাইল দূরে ১৯টি জাহাজ আটকে দেওয়া হয়। কর্মীরা বর্ণনা করেছেন, ইসরাইলি নৌযানগুলো ওয়াটার ক্যানন, সতর্কবার্তা এবং বাজেয়াপ্তের হুমকি দিয়েছে। তবুও অনেক নৌকা সামনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে।
রয়টার্স জানিয়েছে, ভোর হওয়ার আগেই অজ্ঞাত জাহাজ ফ্লোটিলার কাছে আসে এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করে দেয়। এ সময় স্টান গ্রেনেড ও সংকেত দমনের অভিযোগও ওঠে। যদিও ইসরাইল এসব অভিযোগের সত্যতা আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করেনি।
আটক ও গ্রেফতার
আয়োজকদের দাবি, অন্তত ১৩টি নৌকা থামিয়ে দেওয়া হয়েছে। আটক হয়েছেন দুই শতাধিক কর্মী, যার মধ্যে সুইডিশ জলবায়ু কর্মী গ্রেটা থানবার্গও রয়েছেন। আল জাজিরার খবরে বলা হয়েছে, ফ্লোটিলার ২৪টি জাহাজ এখনও সক্রিয়, যার কয়েকটি ইতিমধ্যেই গাজার উপকূলের কাছাকাছি অবস্থান করছে।
এ ঘটনার সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ারও যোগসূত্র তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশের বিশিষ্ট ফটোগ্রাফার শহিদুল আলম এই অভিযানে অংশ নিচ্ছেন। তিনি এটিকে গাজার জনগণের প্রতি সংহতির প্রতীক বলে উল্লেখ করেছেন এবং পরিস্থিতিকে “গণহত্যা” হিসেবে অভিহিত করেছেন।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
ঘটনাটি আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। ইতালি ও গ্রীস ইসরাইলকে নিরাপদ যাত্রাপথ দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। বাংলাদেশ, পাকিস্তানসহ অন্তত ১৫টি দেশ যৌথ বিবৃতিতে আন্তর্জাতিক আইন মেনে ফ্লোটিলার সুরক্ষা নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছে।
বেলজিয়াম ড্রোন হামলার তদন্ত দাবি করেছে। মালয়েশিয়া নিরাপদ সমুদ্রপথ নিশ্চিতের আহ্বান জানিয়েছে। অন্যদিকে ইসরাইল বিকল্প প্রস্তাব দিয়েছে—ত্রাণবাহী জাহাজগুলোকে অ্যাশকেলন মেরিনায় থামিয়ে সেখান থেকে গাজার দিকে সাহায্য পাঠানোর। তবে আয়োজকরা তা প্রত্যাখ্যান করে বলছেন, “সরাসরি সমুদ্রপথে সাহায্য পৌঁছানোই এই মিশনের উদ্দেশ্য।”
অবরোধের বৈধতা প্রশ্নে বিতর্ক
আইনগত দিক থেকেও প্রশ্ন উঠছে। আন্তর্জাতিক জলসীমায় বেসামরিক জাহাজ আটক করা কতটা বৈধ? ইসরাইলের নৌ-অবরোধ আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী কতটা সঠিক? নিরপেক্ষ জাহাজের অধিকার কী হবে?
ইসরাইলি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অবশ্য এক বিবৃতিতে বলেছে, “গাজার যেসব এলাকায় যুদ্ধ চলছে সেখানে কোনো জাহাজ ঢুকতে দেওয়া হবে না।” তাদের দাবি, নিরাপত্তার জন্য এ অবরোধ প্রয়োজন। কিন্তু সমালোচকদের মতে, এটি মূলত সাধারণ মানুষের ওপর দমন এবং মানবিক অধিকারের চরম লঙ্ঘন।
প্রতীকী গুরুত্ব
যদিও শেষ পর্যন্ত ফ্লোটিলার সব জাহাজ গাজায় পৌঁছাবে কি না, তা অনিশ্চিত। কিন্তু স্পষ্ট যে এই মিশন ইতিমধ্যেই বৈশ্বিক মনোযোগ কেড়েছে। গাজার অবরোধকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে তারা বিশ্ববাসীর সামনে মানবিক সংকটকে নতুনভাবে তুলে ধরেছে।
ফ্লোটিলা আয়োজকরা বলছেন, “এটি কেবল ত্রাণ পৌঁছানো নয়, এটি প্রতিরোধ ও মানবিক নীতির পক্ষে দাঁড়ানোর প্রতীক।” আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোও মনে করছে, সমুদ্রযাত্রার এই অভিযান শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদকে সরাসরি নৌ-সংঘর্ষের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে।
গাজার উদ্দেশে যাত্রা করা ফ্লোটিলা শেষ পর্যন্ত বাধা ভেদ করতে পারবে কি না, তা সময়ই বলে দেবে। তবে ইতিমধ্যেই এই মিশন ইসরাইলি অবরোধ ভাঙার এক অনন্য প্রতীক হয়ে উঠেছে এবং আন্তর্জাতিক পরিসরে নতুন কূটনৈতিক চাপ সৃষ্টি করেছে।
