স্বাস্থ্য মানে কেবল শারীরিক সুস্থতা নয়—মানসিক প্রশান্তিও এর অপরিহার্য অংশ। আমরা প্রায়ই শিশুর শারীরিক স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতন থাকি, কিন্তু তার মানসিক বিকাশের দিকে পর্যাপ্ত মনোযোগ দিই না। অথচ মানসিক স্বাস্থ্যই ভবিষ্যৎ নাগরিক গঠনের মূল ভিত্তি। শৈশবের আবেগ, ভালোবাসা ও পারিবারিক আচরণ এক শিশুর পুরো জীবনকে প্রভাবিত করে।
জন্মের আগেই শুরু হয় মানসিক বিকাশ
শিশুর মানসিক বিকাশ শুরু হয় মাতৃগর্ভ থেকেই। গর্ভাবস্থায় মায়ের শারীরিক সুস্থতা ও মানসিক প্রশান্তি সন্তানের ভবিষ্যৎ আচরণ, মনোভাব ও চিন্তাশক্তির ওপর গভীর প্রভাব ফেলে। মায়ের উদ্বেগ, ভয় বা মানসিক অস্থিরতা শিশুর স্নায়ুতন্ত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। তাই গর্ভাবস্থায় মায়ের মানসিক শান্তি রক্ষা করা শিশুর ভবিষ্যৎ মানসিক স্বাস্থ্যেরও পূর্বশর্ত।
পরিবার—শিশুর প্রথম পাঠশালা
শিশুর জীবনের প্রথম শিক্ষালয় হলো পরিবার। সেখানে মা-বাবার আচরণ, ভাষা, ভালোবাসা ও পারস্পরিক সম্পর্কই শিশুর মানসিক গঠনের মূল উপাদান।
একটি পরিবার যত ভালোবাসাপূর্ণ, সহনশীল ও সংযত হবে—ততই শিশু আত্মবিশ্বাসী ও সৃজনশীল মানুষ হয়ে উঠবে। বিপরীতে, কলহপূর্ণ, সন্দেহপ্রবণ বা হিংসাপূর্ণ পরিবেশ শিশুর মনে ভয়, অনিরাপত্তা ও আক্রমণাত্মক প্রবণতা তৈরি করে।
শিশু প্রথমে মায়ের স্নেহে, পরে বাবার মমতায় এবং তারপর ধীরে ধীরে সমাজের অন্যদের সংস্পর্শে আসে। এই প্রত্যেকটি সম্পর্কই তার মানসিক ভিত্তি গড়ে তোলে। শিশুর সামনে মা-বাবার আচরণই তার কাছে আদর্শ—সেই আচরণে যদি অসততা, কলহ বা হিংসা থাকে, শিশুর মানসিক বিকাশে তার ছাপ পড়বে নিশ্চিতভাবেই।
কৌতূহল দমে গেলে মরে যায় অনুসন্ধিৎসা
প্রতিটি শিশুই জন্ম নেয় প্রবল কৌতূহল নিয়ে। সে জানতে চায়, প্রশ্ন করে, অনুসন্ধান করে—‘এটা কী? ওটা কেন?’
দুঃখজনকভাবে অনেক মা-বাবা শিশুর প্রশ্নে বিরক্ত হন, ধমক দেন বা তুচ্ছজ্ঞান করেন। এতে শিশুর জানার আগ্রহ কমে যায়, আত্মবিশ্বাস হারায়। অথচ এই কৌতূহলই ভবিষ্যতের সৃজনশীল চিন্তার ভিত্তি। শিশুর প্রশ্নের উত্তর ধৈর্য নিয়ে দেওয়া, তার কৌতূহলকে উৎসাহ দেওয়া—এই ছোট্ট বিষয়গুলোই তার মানসিক বিকাশে বড় ভূমিকা রাখে।
মিথ্যা বা দ্বিমুখী আচরণ শিশুর মনে আঘাত হানে
শিশুর মানসিক বিকাশে মা-বাবার আচরণগত সততা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
অনেক সময় মা বলেন, “বাবাকে বলো না,” কিংবা বাবা বলেন, “মাকে জানিও না”—এ ধরনের কথা শিশুকে অজান্তেই মিথ্যাশ্রয়ী করে তোলে। একইভাবে, কেউ যদি শিশুর সামনে অন্যের টাকা নেন বা অসততার কাজ করেন, শিশুর মনে সেই আচরণই ‘স্বাভাবিক’ হিসেবে গেঁথে যায়। ফলে সততা ও নৈতিকতার ধারণা বিকৃত হয়ে যায়।
শিশুর সামনে মা-বাবার উচিত সর্বদা সততা, সংযম ও পারস্পরিক শ্রদ্ধার দৃষ্টান্ত স্থাপন করা। তারা যদি একে অপরকে সম্মান করেন, মতভেদ থাকলেও সংযতভাবে সমাধান করেন—তাহলে সন্তানও সেই মূল্যবোধ শিখে বড় হবে।
বাস্তব জীবনের উদাহরণ
তেরো বছর বয়সে বাবাকে হারানো আদিব তার মায়ের কাছ থেকে পেয়েছিল অবহেলা ও নেতিবাচক ব্যবহার। পরিণত বয়সে সে হয়ে ওঠে মাদকাসক্ত ও বিদ্রোহী। অন্যদিকে নাদিয়া, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে, তার বাবা-মায়ের নিত্যদিনের কলহের কারণে শিক্ষাজীবন ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। দুই ভাইয়ের একজন সরকারি কর্মকর্তা, অন্যজন অপরাধ জগতে জড়িয়ে পড়ে—মূল কারণ, শৈশবেই মানসিক নিরাপত্তার অভাব।
এই বাস্তব চিত্রগুলো আমাদের মনে করিয়ে দেয়—শিশুর মানসিক স্বাস্থ্যের ঘাটতি কেবল ব্যক্তিগত নয়, সামাজিক সমস্যারও জন্ম দেয়।
অতিরিক্ত আবেগ বা অবহেলা—দু’টিই ক্ষতিকর
শিশুর মানসিক বিকাশের জন্য ভারসাম্যপূর্ণ ভালোবাসা জরুরি।
অতিরিক্ত আদর যেমন তাকে দুর্বল করে তোলে, তেমনি অবহেলা তাকে শূন্যতায় ঠেলে দেয়। মা-বাবার দায়িত্ব হলো সন্তানকে স্নেহ দেওয়া, কিন্তু সীমারেখা মেনে। তাকে সিদ্ধান্ত নিতে শেখানো, দায়িত্ববোধ জাগানো এবং ভুল করলে সংযমীভাবে সংশোধন করা—এই শিক্ষাগুলোই তাকে পরিণত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলে।
মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন মানেই ভবিষ্যতের বিনিয়োগ
একটি শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষা মানে একটি সুস্থ সমাজ গঠনের বিনিয়োগ। তাই মা-বাবার উচিত শারীরিক স্বাস্থ্যের মতোই মানসিক বিকাশের প্রতিও সমান মনোযোগ দেওয়া।
শিশুর সামনে সৎ, সহনশীল ও ভালোবাসাপূর্ণ আচরণ করুন—কারণ আপনার প্রতিটি কাজ, প্রতিটি শব্দই তার মনের অদৃশ্য প্রাচীরে রঙ ছড়িয়ে দেয়।
সেই রঙই একদিন গড়ে তোলে তার চরিত্র, নৈতিকতা ও মানবিকতা।
