দেশব্যাপী চলছে মাসব্যাপী ‘টাইফয়েড টিকাদান কর্মসূচি-২০২৫’। সরকারের এই জাতীয় কর্মসূচির আওতায় সারাদেশে ৫ কোটিরও বেশি শিশুকে বিনামূল্যে টাইফয়েড কনজুগেট ভ্যাকসিন (টিসিভি) প্রদান করা হচ্ছে।
প্রাথমিক শ্রেণি থেকে নবম শ্রেণি বা সমমানের শিক্ষার্থীরা এই কর্মসূচির আওতায় বিদ্যালয়ে টিকা পাচ্ছে। পাশাপাশি যেসব শিশু স্কুলে যায় না, তারা তাদের নিকটবর্তী ইপিআই কেন্দ্র বা কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে টিকা নিতে পারছে। কর্মসূচিটি আগামী ১৩ নভেম্বর পর্যন্ত চলবে।
অভিভাবকদের তাদের সন্তানের ১৭ সংখ্যার জন্ম নিবন্ধন নম্বর ব্যবহার করে অনলাইনে vaxepi.gov.bd ওয়েবসাইটে নিবন্ধন করতে হচ্ছে। যেসব শিশুর জন্ম নিবন্ধন নেই, তাদের জন্যও বিশেষ ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
প্রত্যেক শিশুর কাছে টিকা পৌঁছে দিতে সরকার দৃঢ়প্রতিজ্ঞ
রাজধানীর ধানমণ্ডির ম্যাপল লিফ ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে রোববার আনুষ্ঠানিকভাবে এই কর্মসূচির উদ্বোধন করেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) অধ্যাপক ডা. মো. আবু জাফর।
তিনি বলেন,
“সরকারের লক্ষ্য—দেশের প্রতিটি শিশুর কাছে এই নিরাপদ টিকাটি পৌঁছে দেওয়া। যেসব শিশুর জন্ম নিবন্ধন নেই, তাদের আলাদা তালিকা তৈরি করে বিশেষ ব্যবস্থায় টিকা নিশ্চিত করা হবে।”
অধ্যাপক জাফর জানান, ১৯৭৯ সাল থেকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আওতাধীন সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি (ইপিআই) শিশুমৃত্যু ও প্রতিবন্ধকতা কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। প্রতি বছর প্রায় ৪২ লাখ শিশুকে টিকা দেওয়া হয়, যার ফলে প্রায় এক লাখ শিশুর মৃত্যু প্রতিরোধ সম্ভব হয়।
বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো টাইফয়েড টিকা
বাংলাদেশে এই প্রথমবারের মতো জাতীয়ভাবে টাইফয়েড টিকাদান কর্মসূচি শুরু হয়েছে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, টাইফয়েড একটি প্রাণঘাতী টিকা-প্রতিরোধযোগ্য রোগ, যা সালমোনেলা টাইফি ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সৃষ্ট। রোগটি সাধারণত দূষিত পানি, খাবার ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের মাধ্যমে ছড়ায়।
বিশেষভাবে ৯ মাস থেকে ১৫ বছর বয়সী শিশুরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকে। অধ্যাপক জাফর জানান,
“২০২১ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে প্রায় ৮ হাজার মানুষ টাইফয়েডে মারা গেছেন, যার মধ্যে প্রায় ৬ হাজারই ছিল ১৫ বছরের নিচে।”
ওষুধ প্রতিরোধী টাইফয়েড: নতুন উদ্বেগ
বিশ্বব্যাপী টাইফয়েড এখন একটি ওষুধ-প্রতিরোধী সংক্রমণ (ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট ইনফেকশন) হিসেবে দেখা দিচ্ছে। সাধারণ অনেক অ্যান্টিবায়োটিক এখন এই রোগের বিরুদ্ধে কার্যকারিতা হারাচ্ছে, যা চিকিৎসাকে জটিল করে তুলছে।
এই প্রেক্ষাপটে টিকা কার্যক্রমকে একটি কার্যকর প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। অধ্যাপক জাফর বলেন,
“টাইফয়েড টিকা গ্রহণের মাধ্যমে সংক্রমণের হার যেমন কমবে, তেমনি অপ্রয়োজনীয় অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের হারও উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পাবে।”
নিরাপদ, কার্যকর ও হালাল সনদপ্রাপ্ত টিকা
টাইফয়েড কনজুগেট ভ্যাকসিন (টিসিভি) একটি নিরাপদ, কার্যকর ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)-অনুমোদিত টিকা। এতে প্রোটিন ও শর্করা উভয় উপাদান থাকায় এটি দীর্ঘস্থায়ী রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করে।
ডিজি বলেন,
“সরকার শুধুমাত্র পরীক্ষিত ও নিরাপদ টিকাই ব্যবহার করে—কোনো পরীক্ষামূলক টিকা নয়। পাকিস্তান ও নেপালসহ অনেক দেশ ইতোমধ্যে সফলভাবে এই টিকা চালু করেছে।”
তিনি আরও জানান, টিকা নেওয়ার পর সামান্য জ্বর, ব্যথা বা ক্লান্তি দেখা দিতে পারে, যা স্বাভাবিকভাবে কয়েক দিনের মধ্যেই সেরে যায়।
অধ্যাপক জাফর স্পষ্ট করে বলেন,
“এই টিকায় ইসলামী শরীয়তে নিষিদ্ধ কোনো উপাদান নেই। এটি সৌদি আরবের ‘হালাল সেন্টার’ কর্তৃক আনুষ্ঠানিকভাবে হালাল সনদপ্রাপ্ত।”
স্বাস্থ্য খাতে আরেকটি সাফল্যের পদক্ষেপ
সরকারের লক্ষ্য কেবল টাইফয়েড প্রতিরোধ নয়, বরং ভবিষ্যতে একে সম্পূর্ণ নির্মূল করা। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, টিকাদান কর্মসূচির মাধ্যমে বাংলাদেশ ইতোমধ্যে পোলিও নির্মূল, হেপাটাইটিস-বি, হাম, রুবেলা নিয়ন্ত্রণ এবং মাতৃ ও নবজাতক ধনুষ্টঙ্কার নির্মূলে সাফল্য অর্জন করেছে।
টাইফয়েড নির্মূলে এই কর্মসূচি সেই ধারাবাহিকতারই অংশ।
ডা. আবু জাফর আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন,
“টাইফয়েডের টিকা কেবল শিশুদের নয়, গোটা সমাজের স্বাস্থ্য নিরাপত্তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আমরা বিশ্বাস করি, বাংলাদেশের শিশুরা খুব শিগগিরই টাইফয়েডের ঝুঁকিমুক্ত হবে।”










সত্যের সন্ধানে আমরা — NRD News Media Limited