দেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতি উদ্বেগজনক অবস্থায় পৌঁছেছে। এডিস মশাবাহিত এই ভাইরাসজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে গত ২৪ ঘণ্টায় পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে। একই সময়ে ৯৫৩ জন নতুন রোগী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
রোববার (১২ অক্টোবর) স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম থেকে পাঠানো দৈনিক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শনিবার সকাল ৮টা থেকে রোববার সকাল ৮টা পর্যন্ত সারা দেশে নতুন করে ভর্তি হওয়া ডেঙ্গু রোগীদের মধ্যে ঢাকায় সর্বাধিক আক্রান্তের খবর পাওয়া গেছে। এ সময় ঢাকা বিভাগে ১৯৭ জন, যার মধ্যে ঢাকা উত্তর সিটিতে ১৪৭ জন এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে ১২২ জন রোগী ভর্তি হয়েছেন।
রাজধানীর বাইরে ডেঙ্গুর প্রকোপও দ্রুত বাড়ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় চট্টগ্রাম বিভাগে ১০৭ জন, বরিশাল বিভাগে ১৪১ জন, খুলনা বিভাগে ৯৩ জন, রাজশাহী বিভাগে ৬৯ জন, ময়মনসিংহ বিভাগে ৪৬ জন, রংপুর বিভাগে ২৩ জন এবং সিলেট বিভাগে ৮ জন নতুন করে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
এতে করে এ বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মোট ২৩০ জনের মৃত্যু এবং ৫৪ হাজার ৫৫৯ জনের হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে।
ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ছে আশ্বিন মাসেও
সাধারণত সেপ্টেম্বরের পর ডেঙ্গুর প্রকোপ কমে এলেও এবার আশ্বিন মাসে এসে সংক্রমণ আবারও ঊর্ধ্বমুখী। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ বছরের বৃষ্টিপাত ও জলাবদ্ধতা ডেঙ্গু প্রজননের উপযোগী পরিবেশ তৈরি করেছে, যা সংক্রমণ দীর্ঘায়িত করছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “ঢাকা ছাড়াও বিভাগীয় শহরগুলোতে ডেঙ্গু সংক্রমণ উদ্বেগজনক হারে ছড়াচ্ছে। মানুষ সচেতন না হলে এবং স্থানীয় প্রশাসন যদি মশক নিধনে কঠোর না হয়, তবে মৃত্যুর সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।”
হাসপাতালগুলোতে রোগীর চাপ
রাজধানীর বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল ঘুরে দেখা গেছে, ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকায় হাসপাতালের শয্যা সংকট দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে শিশু ও বৃদ্ধ রোগীদের অবস্থা তুলনামূলকভাবে জটিল হচ্ছে।
মুগদা জেনারেল হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসক ডা. রাশেদা পারভীন বলেন, “রোগীরা দেরিতে আসছেন। অনেকেই জ্বরের তৃতীয় বা চতুর্থ দিনে এসে ভর্তি হচ্ছেন, ফলে জটিলতা তৈরি হচ্ছে। সময়মতো পরীক্ষা ও চিকিৎসা নিলে মৃত্যুহার আরও কমানো যেত।”
তিনি আরও বলেন, “প্রচণ্ড গরমে অনেকেই জানালা খোলা রাখছেন, আবার পানির টব বা ড্রামের পানি নিয়মিত ঢেকে রাখছেন না—এসব জায়গাতেই এডিস মশা ডিম পাড়ে। তাই বাড়ি ও অফিসের চারপাশে পানি জমে আছে কি না, তা প্রতিদিন দেখা জরুরি।”
স্থানীয় প্রশাসনের অভিযান ও চ্যালেঞ্জ
ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে নিয়মিত মশক নিধন অভিযান চালানো হলেও অনেক এলাকায় এখনও ড্রেন ও খোলা স্থানে মশার বংশবিস্তার দেখা যাচ্ছে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. শফিকুল ইসলাম বলেন, “আমরা নিয়মিত ওয়ার্ড পর্যায়ে অভিযান চালাচ্ছি, তবে জনগণের সহযোগিতা ছাড়া এই যুদ্ধে জেতা সম্ভব নয়। গৃহস্থালির পরিত্যক্ত জিনিসে জমে থাকা পানি থেকেই সবচেয়ে বেশি এডিস মশা জন্ম নেয়।”
ডেঙ্গু প্রতিরোধে করণীয়
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গু প্রতিরোধে সচেতনতা বাড়ানোই এখন সবচেয়ে কার্যকর উপায়। নিয়মিত বাড়ির আশপাশে পানি জমে আছে কি না তা পরীক্ষা করা, ফুলদানি, পুরনো টায়ার, প্লাস্টিকের পাত্র ইত্যাদি ফেলে দেওয়া বা ঢেকে রাখা, মশার কয়েল বা স্প্রে ব্যবহার করা—এসব মৌলিক সতর্কতাই সংক্রমণ রোধে বড় ভূমিকা রাখতে পারে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, যদি কারও হঠাৎ জ্বর আসে, চোখের পেছনে ব্যথা, শরীরে ব্যথা, রক্তপাত, বমি বা অতিরিক্ত দুর্বলতা দেখা দেয়—তবে অবিলম্বে নিকটস্থ হাসপাতালে যোগাযোগ করতে হবে।
বিশেষজ্ঞদের সতর্কবার্তা
দেশে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে ভয়াবহ ডেঙ্গু পরিস্থিতি দেখা গিয়েছিল ২০২৩ সালে, যখন এক বছরে ১,৭০০-এর বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, বর্তমান হারে সংক্রমণ অব্যাহত থাকলে এ বছরও পরিস্থিতি জটিল আকার নিতে পারে।
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সভাপতি ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন বলেন, “ডেঙ্গু এখন শুধুই স্বাস্থ্য সমস্যা নয়, এটি একটি নগর ব্যবস্থাপনার সংকট। সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও জনসচেতনতা ছাড়া এই যুদ্ধ জেতা সম্ভব নয়।”
