দেশের শিশুদের টিকাদান কার্যক্রমে নতুন মাত্রা যোগ করতে সুনামগঞ্জে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়েছে টাইফয়েড ভ্যাকসিনেশন কর্মসূচি। জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের উদ্যোগে রবিবার সকালে সরকারি জুবিলী উচ্চ বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে এই টিকাদান কার্যক্রমের সূচনা হয়।
উদ্বোধন করেন সুনামগঞ্জের সিভিল সার্জন ডা. জসিম উদ্দিন। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন জেলা প্রশাসক ড. মোহাম্মদ ইলিয়াস মিয়া। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তাপস রঞ্জন ঘোষ এবং সদর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. জশবন্ত ভট্টাচার্য।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে জনস্বাস্থ্যের অগ্রাধিকার
জেলা প্রশাসক ড. মোহাম্মদ ইলিয়াস মিয়া বলেন, “টাইফয়েড একটি প্রতিরোধযোগ্য রোগ, কিন্তু এখনো অনেক শিশুর মধ্যে এটি সংক্রমণ ঘটাচ্ছে। সরকারের এই জাতীয় টিকাদান কর্মসূচি দেশের শিশুদের সুস্থতা ও নিরাপদ ভবিষ্যতের ভিত্তি তৈরি করবে।”
তিনি আরও বলেন, “আমরা চাই, সুনামগঞ্জের প্রতিটি শিশু টিকার আওতায় আসুক। এজন্য শুধু স্বাস্থ্য বিভাগের নয়, অভিভাবক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোরও দায়িত্ব রয়েছে।”
সিভিল সার্জন ডা. জসিম উদ্দিন জানান, সুনামগঞ্জ জেলার ১২টি উপজেলায় ৬ লাখ ৯৯ হাজার ৬৮৭ জন শিশুকে টাইফয়েড টিকার আওতায় আনা হবে। এর মধ্যে প্রাথমিক থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত শিশুর সংখ্যা প্রায় ৪ লাখ ৬৩ হাজার ২৬৮ জন। তিনি বলেন, “সরকারের স্বাস্থ্যনীতির অংশ হিসেবে এই টিকা বিনামূল্যে দেওয়া হচ্ছে, যাতে প্রতিটি শিশু টাইফয়েডের ঝুঁকি থেকে সুরক্ষিত থাকে।”
“টাইফয়েড প্রতিরোধে টিকা সবচেয়ে কার্যকর”
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, টাইফয়েড জ্বর একটি পানিবাহিত সংক্রামক রোগ, যা শিশুদের মধ্যে দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে। সময়মতো টিকা নেওয়া হলে এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি প্রায় ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যায়।
সদর উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. জশবন্ত ভট্টাচার্য বলেন, “টাইফয়েড প্রতিরোধের সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো টিকাদান। পরিচ্ছন্ন পানি ও খাদ্য গ্রহণের পাশাপাশি টিকা নেওয়া হলে শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।”
উপজেলা ভিত্তিক টিকাদানের তথ্য
সুনামগঞ্জ সিভিল সার্জন অফিস সূত্রে জানা গেছে, জেলার প্রতিটি উপজেলায় ৯ মাস থেকে ১৫ বছর বয়সী শিশুদের এই টিকার আওতায় আনা হবে।
সুনামগঞ্জ সদর উপজেলায় ৬৫ হাজার ৮০৫ জন শিশু
শান্তিগঞ্জ উপজেলায় ৫৩ হাজার ৭১৩ জন
ছাতক উপজেলায় ৯৬ হাজার ৬০ জন
দোয়ারাবাজার উপজেলায় ৬৭ হাজার ৩৭৬ জন
বিশ্বম্ভরপুর উপজেলায় ৫৩ হাজার ৬৫৮ জন
তাহিরপুর উপজেলায় ৫৬ হাজার ২৯৬ জন
জামালগঞ্জ উপজেলায় ৫৩ হাজার ৫০৩ জন
ধর্মপাশা উপজেলায় ৬২ হাজার ২৯৯ জন
দিরাই উপজেলায় ৭১ হাজার ২৯৬ জন
শাল্লা উপজেলায় ৩৩ হাজার ১৪৫ জন
জগন্নাথপুর উপজেলায় ৬৪ হাজার ২৯৯ জন
সুনামগঞ্জ পৌরসভা এলাকায় ২২ হাজার ২৩৭ জন শিশু টিকা পাবে।
জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ জানিয়েছে, সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে স্বাস্থ্যকর্মী, শিক্ষক ও স্বেচ্ছাসেবকরা যৌথভাবে এই টিকাদান কর্মসূচি বাস্তবায়ন করবেন।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ইউনিসেফ ও ডব্লিউএইচও প্রতিনিধি
অনুষ্ঠানে জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারী, বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকা, অভিভাবক, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এবং আন্তর্জাতিক সংস্থা ইউনিসেফ ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)–এর প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
ইউনিসেফের প্রতিনিধি অনুষ্ঠানে বলেন, “টাইফয়েড প্রতিরোধে বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই দক্ষিণ এশিয়ায় নেতৃত্ব দিচ্ছে। এই কর্মসূচি সফল হলে আগামী প্রজন্মকে সংক্রামক রোগমুক্ত বাংলাদেশ উপহার দেওয়া সম্ভব হবে।”
সচেতনতাই সফলতার চাবিকাঠি
বক্তারা বলেন, টিকাদান কর্মসূচি সফল করতে জনগণের সচেতনতা সবচেয়ে জরুরি। অভিভাবকদের প্রতি আহ্বান জানানো হয় যেন তারা সময়মতো শিশুদের নিয়ে টিকাকেন্দ্রে আসেন এবং প্রচারিত গুজবে কান না দেন।
সিভিল সার্জন ডা. জসিম উদ্দিন বলেন, “টাইফয়েড প্রতিরোধে আমরা মাঠপর্যায়ে নিবিড় মনিটরিং করছি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে আমাদের মেডিকেল টিম রয়েছে। প্রত্যেক শিশুকে টিকার আওতায় আনতে আমরা বদ্ধপরিকর।”
স্বাস্থ্য সুরক্ষায় নতুন পদক্ষেপ
টাইফয়েড টিকাদান কার্যক্রমের মাধ্যমে দেশের জাতীয় টিকাদান কর্মসূচিতে যুক্ত হলো আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের মতে, এই উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে ভবিষ্যতে টাইফয়েড সংক্রমণের হার উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পাবে এবং শিশু মৃত্যুহার কমবে।
