দেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতি ক্রমেই উদ্বেগজনক হয়ে উঠছে। গত ২৪ ঘণ্টায় এ রোগে আরও চারজনের মৃত্যু হয়েছে এবং নতুন করে ৭৮১ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। বৃহস্পতিবার (৯ অক্টোবর) স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জারি করা দৈনিক প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
এ নিয়ে চলতি বছরের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৫২ হাজার ৮৮৫ জন, আর মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২২৪ জনে।
নতুন মৃত্যুর সবই পুরুষ
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত এক দিনে মারা যাওয়া চারজনই পুরুষ, যাদের বয়স ১৩, ১৪, ৩৯ ও ৫৫ বছর। তাদের মধ্যে দুজন চিকিৎসাধীন ছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে, একজন কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে এবং অন্যজন মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।
চলতি বছরেও পুরুষদের মধ্যে ডেঙ্গু সংক্রমণ ও মৃত্যুহার তুলনামূলক বেশি বলেই উল্লেখ করছে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, পুরুষদের মধ্যে বাইরে কাজ করার প্রবণতা বেশি হওয়ায় মশার সংস্পর্শে আসার ঝুঁকিও তুলনামূলক বেশি।
ঢাকায় আক্রান্তের সংখ্যা এখনও সর্বোচ্চ
গত ২৪ ঘণ্টায় সর্বাধিক রোগী ভর্তি হয়েছেন ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে—সংখ্যা ২৭৮ জন। রাজধানীসহ ঢাকা বিভাগে মোট ১০১ জন নতুন করে ভর্তি হয়েছেন।
এ ছাড়া, ময়মনসিংহ বিভাগে ৪০ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে ৮২ জন, খুলনা বিভাগে ৪৮ জন, রাজশাহী বিভাগে ৬৩ জন, রংপুর বিভাগে ৩২ জন, বরিশাল বিভাগে ১৩০ জন এবং সিলেট বিভাগে ভর্তি হয়েছেন সাতজন রোগী।
বর্তমানে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত ২ হাজার ৪৫২ জন রোগী চিকিৎসাধীন আছেন। এর মধ্যে ঢাকায় ৮২৭ জন, আর ঢাকার বাইরে বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি আছেন ১ হাজার ৬২৫ জন রোগী।
সেপ্টেম্বরেই সর্বাধিক সংক্রমণ ও মৃত্যু
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ডেঙ্গু সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার ছিল সর্বোচ্চ। ওই মাসে হাসপাতালে ভর্তি হন ১৫ হাজার ৮৬৬ জন, আর মৃত্যু হয় ৭৬ জনের।
অক্টোবরের প্রথম আট দিনেই ভর্তি হয়েছেন ৫ হাজার ৫৪৩ জন, আর প্রাণ হারিয়েছেন ২৬ জন।
জুলাই মাসেও সংক্রমণ ছিল তুলনামূলক বেশি—হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন ১০ হাজার ৬৮৪ জন, মৃত্যু হয়েছিল ৪১ জনের।
বছরের শুরু থেকেই বাড়ছে সংক্রমণ
বছরের শুরু থেকেই ধীরে ধীরে বাড়ছে ডেঙ্গুর প্রকোপ। জানুয়ারিতে ভর্তি হয়েছিলেন ১ হাজার ১৬১ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৩৭৪ জন, মার্চে ৩৩৬ জন, এপ্রিলে ৭০১ জন, মে মাসে ১ হাজার ৭৭৩ জন, জুনে ৫ হাজার ৯৫১ জন এবং আগস্টে ১০ হাজার ৪৯৬ জন।
মার্চ মাস ছাড়া প্রায় প্রতিটি মাসেই মৃত্যুর খবর মিলেছে। জানুয়ারিতে ১০ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৩ জন, এপ্রিলে ৭ জন, মে মাসে ৩ জন, জুনে ১৯ জন, জুলাইয়ে ৪১ জন, আগস্টে ৩৯ জন এবং সেপ্টেম্বর মাসে ৭৬ জনের মৃত্যু হয়েছে।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের সতর্কতা
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মৌসুমি পরিবর্তনের সময় (জুলাই থেকে অক্টোবর) ডেঙ্গুর প্রকোপ সবচেয়ে বেশি দেখা দেয়। এসময় শহরাঞ্চলে জমে থাকা পানি, অপর্যাপ্ত মশা নিধন কার্যক্রম এবং সচেতনতার অভাবে সংক্রমণ বেড়ে যায়।
জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) গবেষকরা বলছেন, ডেঙ্গুর ভাইরাস এখন আগের চেয়ে বেশি জটিল হয়ে উঠছে। উপসর্গ অনেক সময় হালকা হলেও রোগের জটিলতা দ্রুত বাড়ছে, বিশেষ করে শিশু ও বয়স্কদের মধ্যে।
২০২৩ ছিল ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ বছর
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ২০০০ সাল থেকে ডেঙ্গু আক্রান্ত ও মৃত্যুর তথ্য সংরক্ষণ করছে। সেই পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৩ সাল ছিল ডেঙ্গুর ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ বছর।
সে বছর মোট ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হন, আর ১ হাজার ৭০৫ জনের মৃত্যু হয়—যা দেশে এক বছরে সর্বোচ্চ মৃত্যুর রেকর্ড।
বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলেছেন, “এখনই যদি মশা নিধন কার্যক্রম জোরদার না করা হয়, তবে চলতি অক্টোবর মাসেও পরিস্থিতি আরও অবনতির আশঙ্কা রয়েছে।”
তারা জনগণকেও নিজ নিজ বাসা-বাড়ি ও কর্মস্থলে জমে থাকা পানি পরিষ্কার রাখার, ফুলদানি ও টবের পানি নিয়মিত বদলানোর এবং মশার কামড় থেকে বাঁচতে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
