মানবদেহের রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা সাধারণত বাইরের আক্রমণকারী—যেমন ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া বা অন্যান্য প্যাথোজেন—থেকে শরীরকে সুরক্ষা দেয়। কিন্তু কখনও কখনও এই ইমিউন সিস্টেম বিভ্রান্ত হয়ে শরীরেরই নিজস্ব কোষ বা অঙ্গকে আক্রমণ করে বসে। এতে দেখা দেয় অটোইমিউন রোগ, যা অনেক সময় প্রাণঘাতী হয়ে ওঠে।
এই বিপজ্জনক ত্রুটি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব—এমন বৈপ্লবিক সত্য প্রমাণ করেছেন যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের তিন বিজ্ঞানী।
তারা হলেন—
🔹 যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটলের ইনস্টিটিউট ফর সিস্টেমস বায়োলজির সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার মেরি ব্রাঙ্কো,
🔹 সান ফ্রান্সিসকোর সোনোমা বায়োথেরাপিউটিকসের বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা ফ্রেড র্যামসডেল, এবং
🔹 জাপানের ওসাকা ইউনিভার্সিটির ইমিউনোলজি ফ্রন্টিয়ার রিসার্চ সেন্টারের অধ্যাপক শিমন সাকাগুচি।
সোমবার (৬ অক্টোবর) চিকিৎসাবিজ্ঞান ও শরীরতত্ত্বে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী হিসেবে তাদের নাম ঘোষণা করে সুইডেনের ক্যারোলিনস্কা ইনস্টিটিউট।
নোবেল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, “পেরিফেরাল ইমিউন টলারেন্স”—অর্থাৎ দেহের রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা যাতে নিজ অঙ্গকে আক্রমণ না করে, সেই প্রতিরোধ কৌশল উদ্ঘাটনের জন্য এই পুরস্কার দেওয়া হয়েছে।
নিয়ন্ত্রক টি-সেল: দেহের নিরাপত্তা প্রহরী
গবেষকদের কাজের মূল বিষয় ছিল টি-সেল নামের সাদা রক্তকোষ নিয়ে। এই কোষ মানবদেহের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার অন্যতম স্তম্ভ, যা সংক্রমণ শনাক্ত করে এবং প্রতিরোধ করে।
তিন বিজ্ঞানী আবিষ্কার করেছেন এক বিশেষ প্রকারের কোষ—“রেগুলেটরি টি-সেল” বা নিয়ন্ত্রক টি-সেল—যা দেহের প্রতিরোধ প্রক্রিয়ায় ভারসাম্য রক্ষা করে।
এই কোষের কাজ হলো, রোগজীবাণুর বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে শরীরের নিজস্ব কোষ যাতে আক্রান্ত না হয়, তা নিশ্চিত করা।
দেহের ইমিউন সিস্টেম যদি নিজ অঙ্গকে আক্রমণ করে, তখন তৈরি হয় অটোইমিউন রোগ—যেমন টাইপ-১ ডায়াবেটিস, লুপাস বা মাল্টিপল স্ক্লেরোসিস। বর্তমানে ৮০টিরও বেশি অটোইমিউন রোগ শনাক্ত করা হয়েছে, যেগুলোর অধিকাংশেরই কোনো স্থায়ী চিকিৎসা নেই।
গবেষণার মূল আবিষ্কার
নোবেল ওয়েবসাইটে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, মানবদেহের ইমিউন সিস্টেমের একটি বড় রহস্য হলো—এটি কীভাবে নির্ধারণ করে কোন অনুজীবকে আক্রমণ করবে আর কোনটিকে রক্ষা করবে।
সাকাগুচি, ব্রাঙ্কো ও র্যামসডেল এই রহস্যের সমাধান দিয়েছেন।
তারা দেখিয়েছেন, টি-সেলের রেগুলেটরি সংস্করণ ইমিউন সিস্টেমের “নিরাপত্তা প্রহরী” হিসেবে কাজ করে।
টি-সেলের ওপর থাকে বিশেষ প্রোটিন টি-সেল রিসেপ্টর, যা শরীরের কোষ স্ক্যান করে। কোনো বিপজ্জনক প্যাথোজেন শনাক্ত হলে এই রিসেপ্টর থেকে সংকেত পাঠানো হয়—“শরীর আক্রমণের মুখে!”
১৯৮০-এর দশকেই বিজ্ঞানীরা বুঝতে শুরু করেছিলেন, টি-সেল থাইমাস গ্রন্থিতে গঠিত হয় এবং সেখানেই সংক্রমণ চেনার প্রশিক্ষণ পায়।
এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় “সেন্ট্রাল টলারেন্স”, যা পরবর্তীতে সাকাগুচির আবিষ্কারে নতুন মাত্রা পায়।
ইঁদুরে সফল পরীক্ষা
জাপানি গবেষক শিমন সাকাগুচি প্রথম ইঁদুরের শরীরে রেগুলেটরি টি-সেল শনাক্ত করেন।
তিনি দেখতে পান, এই কোষগুলোই ইঁদুরকে অটোইমিউন রোগ থেকে রক্ষা করছে।
১৯৯৫ সালে প্রকাশিত গবেষণায় তিনি দেখান, নতুন এই টি-সেল সিডি২৫ প্রোটিন বহন করে—যা ইমিউন সিস্টেমকে শান্ত রাখে এবং অযাচিত আক্রমণ থেকে বিরত রাখে।
অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের মেরি ব্রাঙ্কো ও ফ্রেড র্যামসডেল অটোইমিউন রোগ থেকে সুস্থ হওয়া ইঁদুরের জিন বিশ্লেষণ করতে গিয়ে শনাক্ত করেন ‘এফওএক্সপি৩ (FOXP3)’ নামের একটি গুরুত্বপূর্ণ জিন।
এই জিনের ত্রুটি থাকলে দেহে অটোইমিউন প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়।
তাদের এই আবিষ্কার ইমিউনোলজি গবেষণায় এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে।
ভবিষ্যৎ চিকিৎসায় নতুন দিগন্ত
বর্তমানে গবেষকেরা চেষ্টা করছেন কীভাবে নিয়ন্ত্রক টি-সেল ব্যবহার করে অটোইমিউন রোগ বা ক্যান্সারের চিকিৎসা উন্নত করা যায়।
এর মধ্যে রয়েছে—
🔹 রোগীদের শরীরে ইন্টারলিউকিন-২ সাইটোকাইন প্রয়োগ করে নিয়ন্ত্রক টি-সেলের সংখ্যা বৃদ্ধি করা।
🔹 রোগীর দেহ থেকে নিয়ন্ত্রক টি-সেল আলাদা করে ল্যাবে বৃদ্ধি করে পুনরায় শরীরে প্রবেশ করানো।
🔹 জিন পরিবর্তনের মাধ্যমে নির্দিষ্ট অঙ্গ বা টিউমারে লক্ষ্যভিত্তিক টি-সেল পাঠিয়ে প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই গবেষণা অঙ্গ প্রতিস্থাপনেও বিপ্লব আনতে পারে। কারণ প্রতিস্থাপিত অঙ্গের প্রতি দেহের প্রতিরোধ প্রতিক্রিয়া (রিজেকশন) কমিয়ে নতুন অঙ্গকে দীর্ঘমেয়াদি সুরক্ষা দেওয়া সম্ভব হবে।
মানবতার কল্যাণে আবিষ্কারের জয়গান
নোবেল কমিটি এক বিবৃতিতে বলেছে, “রেগুলেটরি টি-সেলের আবিষ্কার মানবদেহের প্রতিরোধ ব্যবস্থার এক নতুন অধ্যায় উন্মোচন করেছে। এটি শুধু রোগ বোঝার ক্ষেত্রেই নয়, চিকিৎসা ও জীবনরক্ষার ক্ষেত্রেও এক বিশাল সাফল্য।”
এই আবিষ্কার প্রমাণ করেছে—মানবদেহের ভেতরেই রয়েছে সুরক্ষার স্বাভাবিক কৌশল, যা বুঝে ও কাজে লাগাতে পারলেই রোগ ও মৃত্যু থেকে মুক্তির নতুন পথ তৈরি করা সম্ভব।
