বাংলা চলচ্চিত্রের আকাশে ধূমকেতুর মতো উদিত হয়েছিলেন চিত্রনায়ক সালমান শাহ। নব্বইয়ের দশকে তরুণ প্রজন্মের হৃদয়জুড়ে জায়গা করে নেওয়া এই তারকার অকাল মৃত্যু আজও রহস্যে ঘেরা। দুই যুগেরও বেশি সময় পর যখন মামলাটি আত্মহত্যা থেকে হত্যায় রূপ নিয়েছে, তখন আবারও আলোচনায় উঠে এসেছে এক বিস্মৃত নাম—রমেশ, যিনি ময়নাতদন্তের সময় নায়কের মরদেহে ছুরি চালিয়েছিলেন।
ধর্মান্তরিত হয়ে এখন তার নাম সেকান্দার রমেশ। ৩৫ বছরের সরকারি চাকরি শেষে তিনি বর্তমানে অবসরজীবন কাটাচ্ছেন। সময় পেরিয়ে গেলেও ১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বরের সেই দিনটি আজও যেন চোখের সামনে ভাসে তাঁর।
“বিশ্বাস হচ্ছিল না সালমান মারা গেছেন”
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সেই পুরনো মর্গে কাজ করতেন রমেশ। সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন,
“সেদিন সরকারি ছুটি ছিল। হঠাৎ খবর এল—নায়ক সালমান শাহর মরদেহ আনা হচ্ছে। বিশ্বাসই হচ্ছিল না, আমাদের প্রিয় নায়ক মারা গেছেন!”
তিনি স্মৃতিচারণ করে আরও বলেন,
“লাশটি যখন মর্গে এলো, তখন বাইরে হাজার হাজার মানুষ। শোবিজের প্রায় সবাই হাজির—নায়ক-নায়িকা, পরিচালক, সাধারণ মানুষ—সবাই কাঁদছে। এমন কান্না আমি জীবনে দেখিনি।”
রমেশের কণ্ঠ ভারী হয়ে আসে,
“চিকিৎসকের নির্দেশে আমারই হাতে ছুরি ছিল। অথচ সেই লাশটা আমার প্রিয় নায়কের। মনে হচ্ছিল, আমি যেন নিজের বুকেই ছুরি চালাচ্ছি। ময়নাতদন্তের কাজটা সেদিন করতে করতে হাত কাঁপছিল।”
মর্গের সেই শীতল ঘর আর উত্তাল জনতা
ঢাকা মেডিক্যালের পুরনো মর্গে তখন ছিল না কোনো আধুনিক সরঞ্জাম। গরমে ঘর টিনের চালে ফুটছিল, বাইরে জনতার চাপ বাড়ছিল প্রতি মুহূর্তে। রমেশ বলেন,
“চিকিৎসক বললেন, দ্রুত কাজ শেষ করতে হবে। ভেতরে আমরা কাজ করছি, বাইরে জনতা ‘সালমান ভাই’ বলে হাহাকার করছে। কেউ বলছে হত্যা, কেউ আত্মহত্যা—কিন্তু কারও মুখে বিশ্বাসের ছাপ নেই।”
ময়নাতদন্ত শেষ হওয়ার পর রমেশ মরদেহ ঢেকে দেন সাদা চাদরে। তিনি বলেন,
“সেদিনের পর বহু লাশ কাটেছি, হাজার হাজার… কিন্তু সালমান শাহর দেহে ছুরি চালানোর সময় যে অনুভূতি হয়েছিল, সেটা আজও ভুলতে পারিনি।”
এক যুগের ভালোবাসা আর রহস্য
১৯৯৬ সালে রাজধানীর ইস্কাটনে নিজ ফ্ল্যাটে সালমান শাহকে ঝুলন্ত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। পুলিশ প্রাথমিকভাবে ঘটনাটিকে আত্মহত্যা হিসেবে ধরে নেয়। সেই সময় সালমানের স্ত্রী সামিরা হক-ও বলেছিলেন, “এটি আত্মহত্যা।” কিন্তু পরিবার ও ভক্তদের দাবি ছিল, সালমান শাহকে হত্যা করা হয়েছে।
দীর্ঘ তদন্ত, সাক্ষ্য-প্রমাণ ও নানা জটিলতার পর গত ২০ অক্টোবর আদালত মামলাটিকে হত্যা মামলা হিসেবে পুনরায় তদন্তের নির্দেশ দেন। এরপরই পুনরায় আলোচনায় আসে পুরোনো সব চরিত্র—পরিবার, সহশিল্পী, তদন্ত কর্মকর্তাদের পাশাপাশি এখন আলোচনায় সেই রমেশও।
“আমরা কেবল দায়িত্ব পালন করেছিলাম”
নিজের ভূমিকা নিয়ে রমেশ বলেন,
“আমরা তো চিকিৎসকের নির্দেশেই কাজ করতাম। কে মারা গেছে, কেমনভাবে মারা গেছে—এসব বিশ্লেষণ আমাদের দায়িত্ব ছিল না। কিন্তু যেদিন জানলাম সালমানের মৃত্যু হত্যার মামলা হিসেবে নতুন করে খোলা হয়েছে, বুকের ভেতর কিছু যেন নড়ে উঠল। মনে হলো, হয়তো সত্যটা এবার বেরিয়ে আসবে।”
ভক্তদের অশ্রু আর অপূর্ণ উত্তর
সালমান শাহর মৃত্যু যেন একটি প্রজন্মের হৃদয়ে স্থায়ী ক্ষত রেখে গেছে। ‘কিয়ামত থেকে কিয়ামত’, ‘অনন্ত ভালোবাসা’, ‘সুজন সখী’, ‘তুমি আমার’—এইসব চলচ্চিত্রের অমর নায়ক ছিলেন তিনি। মাত্র চার বছরের চলচ্চিত্রজীবনে তিনি যে ভালোবাসা পেয়েছিলেন, তা এখনো অটুট।
রমেশের ভাষায়,
“সালমান শাহ কেবল একজন নায়ক ছিলেন না, তিনি ছিলেন মানুষের অনুভূতির অংশ। আমি সরকারি চাকরি করেছি, বহু লাশ দেখেছি, কিন্তু এমন শোক, এমন কান্না আর দেখিনি।”
আজও সেই ঘটনা ঘিরে নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খায়—এটি কি আত্মহত্যা, না পরিকল্পিত হত্যা? আদালতের নতুন নির্দেশের পর হয়তো সময়ই বলবে সত্যি কী ঘটেছিল।
আর রমেশ, যিনি একদিন “নিজের প্রিয় নায়কের বুকে ছুরি চালাতে” বাধ্য হয়েছিলেন, তাঁর সেই কথাগুলো যেন আজও বাংলাদেশের কোটি ভক্তের মনের প্রতিধ্বনি হয়ে বাজে—
“আমার প্রিয় নায়কের বুকে আমি নিজেই ছুরি চালাই… কিন্তু সেদিন আমার নিজের বুকটাও যেন কেটে গিয়েছিল।”










সত্যের সন্ধানে আমরা — NRD News Media Limited