অভিনেত্রী, মডেল, লেখক — বহুমাত্রিক এক শিল্পী শানারেই দেবী শানু। বহু বছর পর আবারও বড় পর্দায় ফিরেছেন তিনি ‘সাত ভাই চম্পা (আদি পর্ব)’ সিনেমার মাধ্যমে। একই সঙ্গে বাংলাদেশ টেলিভিশনের নতুন ধারাবাহিক ‘জল জোছনা’-তে অভিনয় করছেন। সম্প্রতি তিনি কথা বলেছেন এমদাদুল হক মিলটনের সঙ্গে— সিনেমা, নাটক, লেখা ও নিজের শিল্পজীবন নিয়ে।
‘সাত ভাই চম্পা’: রূপকথার রাজ্যে ফেরার গল্প
সিনেমাটি মুক্তির পর দর্শকের ভালোবাসায় আপ্লুত শানু। তিনি বলেন,
“সিনেমা মুক্তির পর থেকে অসংখ্য মানুষের শুভেচ্ছা পাচ্ছি। বিশেষ করে যারা আগে টেলিভিশন ভার্সন দেখেছিলেন, তারা এবার নস্টালজিয়া নিয়ে হলে গেছেন। সবচেয়ে ভালো লাগছে— মানুষ পরিবার নিয়ে দেখছে। অনেকেই বলছেন, তাদের শৈশবের গল্প যেন আবার জীবন্ত হয়ে উঠেছে।”
তবে সিনেমাটি অল্পসংখ্যক হলে মুক্তি পেয়ে কিছুটা আফসোসও রয়ে গেছে তার।
“সংখ্যা কম ছিল, এটা ঠিক। কিন্তু আমি মন খারাপ করিনি। আমার কাছে এ মুক্তি ছিল ‘মেঘ না চাইতে বৃষ্টি’র মতো। ২০১৮ সালে শুটিং শেষ হয়েছিল, এরপর অনেক বছর অপেক্ষা করেছি। যখন শুনলাম মুক্তি পাচ্ছে, মনে হয়েছিল আমার পরিশ্রম অবশেষে দর্শকের সামনে পৌঁছাচ্ছে। রূপকথার এই গল্প এমন এক সময়ে আসছে, যখন সমাজে হালকা ও মানবিক কনটেন্টের খুব দরকার।”
তিনি আরও বলেন, “ছোট পরিসর থেকেও সিনেমাটি নিজের জায়গা তৈরি করছে। মানুষ শুনে শুনেই যাচ্ছে, খুঁজে পাচ্ছে। প্রচারণায় হয়তো কিছুটা ঘাটতি ছিল, কিন্তু আমি বিশ্বাস করি— গল্প ও আবেগ যদি সত্য হয়, তবে দর্শক তা খুঁজে নেয়।”
“সেটেই সবাই ডাকত ‘বড় রানী’”
শুটিংয়ের অভিজ্ঞতা প্রসঙ্গে শানুর কণ্ঠে নস্টালজিয়ার আবেশ:
“এই কাজটা আমার জীবনের সবচেয়ে ভালোবাসার প্রজেক্টগুলোর একটি। সেটে যখন রাজমহলের মতো সাজগোজ করে ঢুকতাম, সবাই মজা করে আমাকে ‘বড় রানী’ বলে ডাকত। তখন সত্যিই নিজেকে রানী মনে হতো। পুরো সেটের আবহ, পোশাক, আলো— সব মিলিয়ে যেন এক সময়ের রূপকথার পৃথিবীতে বাস করছিলাম।”
তিনি বলেন, “অনেক বছর ধরে আমরা এই সিনেমার জন্য অপেক্ষা করেছি। এতে শুধু অভিনয় নয়, ভালোবাসা ও শ্রম জড়ানো আছে প্রতিটি ফ্রেমে।”
‘জল জোছনা’ দিয়ে নাটকে প্রত্যাবর্তন
দীর্ঘ বিরতির পর টেলিভিশনে ফিরেছেন ‘জল জোছনা’ ধারাবাহিকের মাধ্যমে।
“নির্মাতা সোহেল আরমান ভাই নিজেই স্ক্রিপ্ট লিখেছেন। তাঁর লেখার আমি বরাবর ভক্ত। তিনি একদিন ফোন দিয়ে বললেন, ‘তুমি এই চরিত্রটা করো।’ তখন মনে হলো, ঠিক সময়েই যেন সঠিক দিকনির্দেশনা পেলাম।”
ধারাবাহিকটি বাংলাদেশ টেলিভিশনের জন্য নির্মিত। ঢাকাসহ নবাবগঞ্জেও হয়েছে শুটিং।
“সেটের পরিবেশ ছিল খুব আন্তরিক। সবাই যেন একটা পরিবারের মতো কাজ করছিল। আমার জন্য এটি ছিল আত্মবিশ্বাস ফিরে পাওয়ার সময়। ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে বুঝলাম— আমি এখনও প্রস্তুত।”
নাটকটির গল্প নিয়ে শানু বলেন,
“এটি পারিবারিক ও সামাজিক টানাপোড়েনের গল্প। আমার চরিত্রের নাম কাজল, আর সোহেল আরমান ভাই রুদ্র চরিত্রে। নব্বইয়ের দশকের বিটিভি ধারার মতো সংলাপ, গতি আর আবহ আছে এতে। পুরো পরিবার একসঙ্গে বসে দেখার মতো কাজ।”
অভিনয় জীবনের দুই দশক: শেখা ও অপেক্ষার গল্প
দীর্ঘ অভিনয়জীবনের দিকে ফিরে তাকিয়ে শানু বলেন,
“সময়টা কখন চলে গেল, টেরই পাইনি। এই সময়ে অনেক সিনিয়র শিল্পী ও নির্মাতার সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। তাদের ভালোবাসা আমাকে ধরে রেখেছে। তবে একটা আফসোস রয়ে গেছে— এখনও মনে হয় নিজের সেরাটা দিতে পারিনি। এমন চরিত্র পাইনি, যা করে বলতে পারি ‘হ্যাঁ, এবার তৃপ্ত।’ সেই চরিত্রের অপেক্ষায় আছি।”
বড় পর্দায় ফেরার ইচ্ছা
‘মিস্টার বাংলাদেশ’ সিনেমার পর বড় পর্দায় আর দেখা যায়নি তাকে। কারণ জানতে চাইলে বলেন,
“যে ধরনের চরিত্র খুঁজছিলাম, তার প্রস্তাব পাইনি। বাণিজ্যিক ঘরানার ছবির জন্য নিজেকে তখন প্রস্তুত মনে হয়নি। কিন্তু এখন সময় বদলেছে— নতুন ধরণের গল্প আসছে, দর্শকও সেগুলো গ্রহণ করছে। ভালো গল্প ও চরিত্র পেলে অবশ্যই আবার বড় পর্দায় ফিরব।”
লেখালেখির জগতে
শানু শুধু অভিনেত্রী নন, একজন লেখকও। তাঁর লেখালেখির ব্যস্ততাও চলছে সমান্তরালভাবে।
“আগামী বইমেলার জন্য কিছু লিখছি— মণিপুরি মিথলজির ওপর ভিত্তি করে। এটা উপন্যাস হবে, না অন্য কোনো ফর্মে যাবে, এখনও ঠিক হয়নি। আমি একসঙ্গে দুটো কাজ করতে পারি না; অভিনয়ে মন দিলে লেখালেখি থেমে যায়। তাই ধীরে কিন্তু মন দিয়ে এগোচ্ছি।”
অভিনয়, গল্প বলা আর সৃজনশীলতার ভেতর দিয়েই বাঁচেন শানারেই দেবী শানু।
“আমি এখনও শিখছি, এখনও বেড়ে উঠছি,”— বললেন তিনি।
“একদিন এমন একটি চরিত্রে কাজ করতে চাই, যেখানে কাজ শেষে মনে হবে— এবার সত্যিই নিজেকে খুঁজে পেয়েছি।”
