বাংলা সংস্কৃতি, সঙ্গীত ও দর্শনের ইতিহাসে ফকির লালন শাহ এমন এক ব্যক্তিত্ব, যিনি ধর্ম, জাত ও বর্ণের সীমারেখা পেরিয়ে মানবতার বাণী ছড়িয়ে গেছেন সারা বাংলায়। তাঁর সেই দর্শনকেই নতুন করে স্মরণ করলেন জনপ্রিয় অভিনেত্রী জয়া আহসান।
তিনি বলেন, “সাঁইজি কোনো নির্দিষ্ট ধর্মের মানুষ না হয়েও মানবতার ধর্মের কথা বলেছেন। আজকের পৃথিবীতে সেই চর্চাটাই সবচেয়ে জরুরি।”
বৃহস্পতিবার (১৬ অক্টোবর) সন্ধ্যায় রাজধানীর আগারগাঁওয়ে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর অডিটোরিয়ামে ভারতের হাইকমিশন ও ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টারের (আইজিসিসি) আয়োজনে অনুষ্ঠিত বিশেষ সংগীতানুষ্ঠান ‘লালন সন্ধ্যা’-য় অংশ নিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে এ কথা বলেন তিনি।
লালনের দর্শনই মানবতার শিক্ষা দেয়
জয়া আহসান বলেন, “আমরা আজ এক ধরনের ‘আমিত্বে’ ভুগছি—সবকিছু নিজের জন্য, নিজের ঘেরাটোপে। লালন সাঁই আমাদের শিখিয়েছেন, এই আত্মকেন্দ্রিকতা ভেঙে সবার জন্য ভাবাই মানবতার পথ। তিনি দেখিয়েছেন, মানুষই মানুষের ধর্ম, ভালোবাসাই সবচেয়ে বড় সত্য।”
তিনি আরও বলেন, “এই অনুষ্ঠানে আমরা শুধু সঙ্গীত উপভোগ করতে আসিনি; বরং লালনের দর্শন আমাদের মধ্যে ধারণ করার প্রয়াস থাকা উচিত। তরুণ প্রজন্মের কাছে এই মানবতার বার্তা পৌঁছে দেওয়া আমাদের দায়িত্ব।”
অভিনেত্রীর মতে, লালনের বাণী আজকের সময়েও গভীরভাবে প্রাসঙ্গিক। “এই বিভক্ত সময়, ধর্মীয় ও সামাজিক বিদ্বেষের যুগে যদি কেউ আমাদের সহমর্মিতা শেখাতে পারে, তিনি ফকির লালন শাহ।”
সংগীত সন্ধ্যায় সুরে-সুরে মানবতার কথা
‘লালন সন্ধ্যা’-তে শিল্পী, গবেষক ও তরুণ প্রজন্মের শত শত মানুষ ভরে তোলেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের অডিটোরিয়াম। মঞ্চে একে একে পরিবেশিত হয় লালনের কালজয়ী গান—মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি, সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে, খাঁচার ভিতর অচিন পাখি ইত্যাদি।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বিদ্যা সিনহা মীম, তাসনিয়া ফারিণ, সংগীতশিল্পী বর্ণালী, গবেষক নূরজাহান বেগমসহ দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের বিশিষ্টজনেরা।
মঞ্চজুড়ে গানে গানে যেন প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল লালনের সেই চিরন্তন বাণী—ধর্ম নয়, মানবতাই সর্বোচ্চ সত্য।
ভারতের হাইকমিশনারের বক্তব্য
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ভারতের হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা। তিনি বলেন,
“লালন ফকিরের সঙ্গীতেই তাঁর দর্শন প্রতিফলিত হয়। তাঁর সুর ও কথা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, ভারত ও বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক বন্ধন কেবল জাতীয় সীমানায় সীমাবদ্ধ নয়—এটি আত্মার বন্ধন।”
ভার্মা বলেন, “লালনের দর্শন আমাদের শেখায় যে, ধর্ম নয়, মানবিকতা ও ভালোবাসাই মানুষকে এক সুতোয় গেঁথে রাখে। এই বার্তা দুই বাংলার সংস্কৃতিকে চিরন্তন করেছে।”
লালনের দর্শন: আজও প্রাসঙ্গিক
ফকির লালন শাহের সঙ্গীত মানেই আত্মার সঙ্গীত। তাঁর গান শুধু ধর্মীয় নয়, দার্শনিকও—যেখানে মানুষ ও মানবতার গভীর উপলব্ধি প্রকাশ পায়। সমাজে বিভাজন, অসহিষ্ণুতা ও বিদ্বেষের সময়ে তাঁর বাণী নতুন করে ভাবতে শেখায়।
সঙ্গীতপ্রেমীদের মতে, লালনের দর্শন শুধু অতীতের নয়, এটি আজকের মানবজীবনেরও পথনির্দেশনা। সমাজে সমতা, সহমর্মিতা ও ভালোবাসার চেতনা জাগাতে তাঁর শিক্ষা আজও দিকনির্দেশক।
শেষে জয়া আহসানের বার্তা
অনুষ্ঠান শেষে জয়া আহসান বলেন, “লালনের গান আমাদের ভেতরে ঢুকে যায়। তাঁর দর্শন আত্মাকে নাড়া দেয়। আমরা যদি একটু ভালোভাবে বুঝতে পারি তাঁর কথা—‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি’—তাহলে পৃথিবী আরও সুন্দর হয়ে উঠবে।”
ফকির লালন শাহের দর্শন মানবতার বাণী বহন করে—জয়া আহসান। ‘আমিত্বের’ বেড়া পেরিয়ে সবার জন্য ভাবাই সাইঁজির শিক্ষা, বললেন অভিনেত্রী। 🌼🎶
