চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু) নির্বাচনে দীর্ঘ ৩৩ বছর পর উৎসবমুখর পরিবেশে অনুষ্ঠিত ভোটগ্রহণে বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী অংশ নিয়েছেন। প্রধান নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক ড. মনির উদ্দিন জানিয়েছেন, এবারের নির্বাচনে মোট ভোটের ৬০ শতাংশেরও বেশি ভোট পড়েছে।
আজ বুধবার (১৫ অক্টোবর) সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৪টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত চলে ভোটগ্রহণ। এরপর থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছয়টি কেন্দ্রে শুরু হয়েছে ভোট গণনা। প্রধান নির্বাচন কমিশনার জানান, ফলাফল গণনা শেষ হলে ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ মিলনায়তনে আনুষ্ঠানিকভাবে ফলাফল ঘোষণা করা হবে।
উৎসবের আমেজে শিক্ষার্থীরা
দীর্ঘ বিরতির পর অনুষ্ঠিত এই নির্বাচনে সকাল থেকেই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছিল উৎসবের আমেজ। বিভিন্ন অনুষদ ও বিভাগীয় কেন্দ্রগুলোতে শিক্ষার্থীদের দীর্ঘ লাইন দেখা যায়। অনেকেই ভোট দিতে সকাল থেকেই সারিবদ্ধভাবে অপেক্ষা করছিলেন।
ছাত্রছাত্রীদের মুখে ছিল উত্তেজনা, উচ্ছ্বাস ও প্রত্যাশা। প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী নুসরাত জান্নাত বলেন,
“আমরা ইতিহাসের সাক্ষী হতে পেরেছি। ক্যাম্পাসে এমন ভোটের পরিবেশ এর আগে দেখিনি। সবাই শান্তিপূর্ণভাবে ভোট দিয়েছে।”
অন্যদিকে, ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী তানভীর আহমেদ বলেন,
“চাকসু শুধু ভোট নয়, এটি আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরে পাওয়ার প্রতীক। আশা করছি নির্বাচিত প্রতিনিধি শিক্ষার্থীদের স্বার্থে কাজ করবেন।”
সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ ভোটগ্রহণ
নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, পুরো নির্বাচন প্রক্রিয়া শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন হয়েছে। কোথাও কোনো ধরনের অনিয়ম বা সহিংসতার খবর পাওয়া যায়নি। ভোটকেন্দ্রগুলিতে শিক্ষক ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় পুলিশ ও র্যাবের সদস্যরা নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক ড. মনির উদ্দিন বলেন,
“নির্বাচনে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ ও শৃঙ্খলাপূর্ণ অংশগ্রহণ আমাদের অনুপ্রাণিত করেছে। এটি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গণতান্ত্রিক চর্চাকে আরও দৃঢ় করবে।”
তিনি আরও জানান,
“ভোট গণনা চলছে। প্রাথমিকভাবে আমরা অনুমান করছি, মোট ভোটের ৬০ শতাংশেরও বেশি শিক্ষার্থী ভোট দিয়েছেন। সবকিছু ঠিক থাকলে আজ রাতেই ফল ঘোষণা করা যেতে পারে, না হলে আগামীকাল সকাল নাগাদ।”
প্রযুক্তিনির্ভর ভোট গণনা ও ফল প্রকাশ
নির্বাচন ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য ও বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিটি সেলের প্রধান অধ্যাপক সাইদুর রহমান জানিয়েছেন, ভোট গণনায় আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে যাতে ফলাফল দ্রুত ও নির্ভুলভাবে ঘোষণা করা যায়।
তিনি বলেন,
“আমরা চাই ফলাফল ঘোষণায় কোনো বিভ্রান্তি বা বিলম্ব না হোক। তাই প্রতিটি কেন্দ্র থেকে গণনার তথ্য আমরা ডিজিটালভাবে সংগ্রহ করছি। সব প্রক্রিয়া শেষ করতে হয়তো আগামীকাল সকাল পর্যন্ত সময় লাগতে পারে।”
দীর্ঘ বিরতির পর গণতান্ত্রিক চর্চার প্রত্যাবর্তন
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বশেষ চাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৯১ সালে। এরপর দীর্ঘ ৩৩ বছর ধরে নানা জটিলতা, প্রশাসনিক স্থবিরতা ও রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে নির্বাচন হয়নি। শিক্ষার্থীদের বহুদিনের দাবির প্রেক্ষিতে এবার প্রধান উপদেষ্টা সরকারের অধীনে কমিশন নির্বাচন আয়োজন করে।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বলছে, এই নির্বাচন শুধু নতুন নেতৃত্ব নির্বাচনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ও সাংগঠনিক সংস্কৃতিতে গণতান্ত্রিক চেতনা ফিরিয়ে আনার একটি ঐতিহাসিক পদক্ষেপ।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শফি আহমেদ বলেন,
“এই নির্বাচন শিক্ষার্থীদের মধ্যে নেতৃত্বের বিকাশ ও দায়িত্ববোধ জাগানোর পথ খুলে দিয়েছে। ভবিষ্যতে প্রতি দুই বছর পর পর এই প্রক্রিয়া নিয়মিতভাবে চালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।”
চাকসু নির্বাচনের তাৎপর্য
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু) মূলত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করে। এটি শিক্ষার্থীদের একাডেমিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ডের নেতৃত্ব দেয়। চাকসুর পুনর্জাগরণকে অনেকে দেশের শিক্ষাঙ্গনে ছাত্র রাজনীতির একটি নতুন অধ্যায় হিসেবে দেখছেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন,
“চাকসু নির্বাচন একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক অনুশীলন। শিক্ষার্থীদের ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিত্বই ভবিষ্যতের নেতৃত্ব গঠনে ভূমিকা রাখবে।”
আগামী পদক্ষেপ
প্রধান নির্বাচন কমিশনার জানিয়েছেন, ভোট গণনা শেষ হলেই ফলাফল প্রকাশ করা হবে এবং পরবর্তী ধাপে চাকসুর প্রথম কার্যনির্বাহী সভা আহ্বান করা হবে। তিনি বলেন,
“আমরা চাই নতুন কমিটি দায়িত্ব নিয়ে শিক্ষার্থীদের জন্য কার্যকর নীতিমালা প্রণয়ন করুক। তাদের কাজের মাধ্যমেই বোঝা যাবে, এই নির্বাচন সত্যিই কতটা ফলপ্রসূ হলো।”
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এখন ফল ঘোষণার অপেক্ষায়। শিক্ষার্থীরা উন্মুখ হয়ে আছেন জানতে—কে হচ্ছেন তাদের নতুন নেতৃত্ব, যাদের হাতে লেখা হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের আগামী দিনের গণতান্ত্রিক যাত্রাপথ।
