লেখকঃ মোঃ নাজমুল ইসলাম (সাংবাদিক ও কলামিস্ট)
বর্তমান বাংলাদেশে কিশোর গ্যাং অপরাধ জগতের এক ভয়াবহ ও দ্রুত বিস্তার লাভ করা সামাজিক সমস্যায় পরিণত হয়েছে, যা কেবল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলছে না, বরং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নৈতিক, সামাজিক ও মানসিক বিকাশের পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে; গবেষণা, সংবাদ প্রতিবেদন এবং মাঠপর্যায়ের পর্যবেক্ষণ থেকে স্পষ্ট হয় যে এ সমস্যার শিকড় বহুস্তরীয়—অর্থনৈতিক বৈষম্য, নগরায়ণের চাপ, বস্তি সংস্কৃতি, পারিবারিক অস্থিরতা, শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটি, বেকারত্ব, রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয়, সামাজিক অবক্ষয়, এবং অনিয়ন্ত্রিত ডিজিটাল কনটেন্টের প্রভাব—সব মিলিয়ে কিশোরদের একটি অংশকে অপরাধের দিকে ঠেলে দিচ্ছে; ১৩ থেকে ১৯ বছর বয়সী এই কিশোররা স্থানীয় মহল্লা বা এলাকা ভিত্তিক সংঘটিত হয়ে একটি আলাদা পরিচয় ও ক্ষমতার গর্ব তৈরি করে, যেটি প্রতিদ্বন্দ্বী গ্যাংয়ের সঙ্গে সংঘর্ষ, এলাকা নিয়ন্ত্রণ, আধিপত্য বিস্তার, এবং অবৈধ আয়ের উৎস যেমন চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, নারী ও কিশোরী শোষণ, অস্ত্রবাজি এবং সাইবার অপরাধের মধ্য দিয়ে প্রতিফলিত হয়; এদের উৎপত্তি বোঝার জন্য প্রথমেই পারিবারিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ জরুরি—অনেক ক্ষেত্রে অভিভাবকের অনুপস্থিতি বা অবহেলা, দাম্পত্য কলহ, আর্থিক অনটন, কিংবা অতিরিক্ত অবাধ স্বাধীনতা শিশু-কিশোরদের একাকী ও অনিয়ন্ত্রিত করে তোলে, ফলে তারা মহল্লার সিনিয়র অপরাধীদের প্রভাবে গ্যাং সংস্কৃতির প্রতি আকৃষ্ট হয়; নগরায়ণের ফলে শহরের প্রান্তিক বস্তি ও আধা-শহুরে এলাকায় যেখানে পর্যাপ্ত শিক্ষা, ক্রীড়া, বিনোদন বা সাংস্কৃতিক কার্যক্রম নেই, সেখানে গ্যাংই হয়ে ওঠে কিশোরদের সামাজিকীকরণের প্রধান ক্ষেত্র; অপরদিকে সস্তা অ্যান্ড্রয়েড ফোন, অবাধ ইন্টারনেট, সামাজিক মাধ্যম ও অনলাইন গেমিং প্ল্যাটফর্ম কিশোর গ্যাংয়ের জন্য হয়ে উঠেছে নিয়োগ, প্ররোচনা ও যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম, যেখানে বিদেশি সিনেমা, ওয়েব সিরিজ ও গানের মাধ্যমে গ্যাং সংস্কৃতি, অস্ত্রের প্রদর্শনী, সহিংসতা ও নারী শোষণের এক বিকৃত গ্ল্যামারাইজেশন কিশোরদের মনে গভীর ছাপ ফেলছে; কিশোরীদের জন্য এ প্রবণতা বহুগুণ ঝুঁকিপূর্ণ—গ্যাং সদস্যরা তাদের প্রেমের ফাঁদে ফেলে, ব্যক্তিগত ছবি বা ভিডিও সংগ্রহ করে ব্ল্যাকমেইল করে, মাদক পরিবহন বা বার্তা আদান-প্রদানের কাজে ব্যবহার করে, এমনকি প্রতিপক্ষ গ্যাংয়ের ওপর চাপ সৃষ্টি করতেও কিশোরীদের শোষণ করে, যা তাদের শারীরিক নিরাপত্তা, মানসিক স্বাস্থ্য, শিক্ষাজীবন ও সামাজিক মর্যাদার ওপর দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে; ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুরসহ বড় শহরে যেমন কিশোর গ্যাং দৃশ্যমান, তেমনি জেলা শহর ও মফস্বল এলাকায়ও এদের প্রভাব দ্রুত বিস্তার লাভ করছে—বিশেষ করে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে এরা স্থানীয় মিছিল-মিটিং, পোস্টারিং ও শক্তি প্রদর্শনে ব্যবহৃত হচ্ছে এবং বিনিময়ে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার একটি অংশের নীরব সমর্থন বা উপেক্ষা পাচ্ছে, যা সমস্যাকে জটিলতর করছে; বিদ্যমান আইনি কাঠামো—শিশু আইন ২০১৩, দণ্ডবিধি, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন, সন্ত্রাসবিরোধী আইন—তাত্ত্বিকভাবে কিশোর অপরাধ দমনের সুযোগ রাখলেও বাস্তবে কিশোর অপরাধীদের বয়স ও শিশু আইন অনুযায়ী বিশেষ সুরক্ষা, প্রমাণ সংগ্রহের জটিলতা, এবং পুনর্বাসনের অব্যবস্থাপনার কারণে শাস্তি কার্যকর হয় না বা অপরাধী পুনরায় অপরাধে জড়িয়ে পড়ে; সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পুলিশ ও র্যাব “গ্যাং তালিকা” তৈরি, বিশেষ অভিযান, সাইবার মনিটরিং, স্কুল-কলেজে সচেতনতা সভা, এবং অভিভাবক-শিক্ষক সমন্বিত নজরদারি শুরু করেছে, কিন্তু তা মূল সমস্যার কেবল শীর্ষভাগ স্পর্শ করছে—গভীর শিকড়ে পৌঁছাতে হলে বহুমুখী পদক্ষেপ নিতে হবে; প্রথমত, পরিবারে বাবা-মায়ের সময়, মনোযোগ ও মানসিক সহায়তা বাড়াতে হবে, যাতে কিশোররা অপরাধী প্রভাবের বাইরে থাকতে পারে; দ্বিতীয়ত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সহপাঠ্যক্রমিক কার্যক্রম, ক্রীড়া, সাংস্কৃতিক ও স্বেচ্ছাসেবী কর্মকাণ্ড বাড়িয়ে কিশোরদের ইতিবাচক সামাজিকীকরণের সুযোগ তৈরি করতে হবে; তৃতীয়ত, স্থানীয় সরকার ও কমিউনিটি পর্যায়ে পুনর্বাসন, কাউন্সেলিং ও দক্ষতা উন্নয়ন কেন্দ্র স্থাপন করতে হবে, যেখানে অপরাধপ্রবণ কিশোরদের বিকল্প জীবনের পথ দেখানো হবে; চতুর্থত, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে কিশোর অপরাধ মোকাবিলায় শিশু মনোবিজ্ঞান, পুনর্বাসন কৌশল ও কমিউনিটি পুলিশিং বিষয়ে বিশেষ প্রশিক্ষণ দিতে হবে; পঞ্চমত, ডিজিটাল নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করে গ্যাংয়ের অনলাইন নিয়োগ, প্রচার ও হুমকি কার্যক্রম দ্রুত শনাক্ত ও বন্ধ করতে হবে; ষষ্ঠত, রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয় নির্মূল করে অপরাধী ও রাজনীতি-পুলিশ যোগসাজশ ভাঙতে হবে, নইলে যেকোনো আইন প্রয়োগ ব্যর্থ হবে; সপ্তমত, গণমাধ্যমের মাধ্যমে সচেতনতা সৃষ্টি ও সফল পুনর্বাসনের উদাহরণ প্রচার করতে হবে, যাতে কিশোররা অপরাধকে গৌরব মনে না করে বরং ঘৃণা করে; সবশেষে, একটি সমন্বিত জাতীয় কৌশল প্রণয়ন জরুরি, যেখানে পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, স্থানীয় সরকার, সিভিল সোসাইটি, গণমাধ্যম ও প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান একসাথে কাজ করবে, কিশোর গ্যাংয়ের বিস্তার রোধ করবে এবং কিশোরীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করবে—কারণ এ সমস্যাকে অবহেলা করা মানে দেশের ভবিষ্যৎকে সহিংসতা ও অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেওয়া, যা জাতীয় উন্নয়ন, সামাজিক স্থিতিশীলতা ও সাংস্কৃতিক অগ্রগতির জন্য ভয়াবহ হুমকি, এবং এই চক্র ভাঙতে হলে এখনই দীর্ঘমেয়াদি, সমন্বিত ও মানবিক পদক্ষেপ নিতে হবে।